বাড়ছে প্রবাসী, কমছে আয়
2023.10.02
ঢাকা
সরকারি দামের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা কমে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০২২ সাল থেকে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি বাড়তে থাকলেও এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রবাসী আয় না বেড়ে বরং কমছে।
সর্বশেষ গত ১ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় এসেছে ১৩৪ কোটি ডলার, যা গত প্রায় সাড়ে তিন বছরে সর্বনিম্ন।
অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠান জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, গত আগস্টে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে গেছেন, যা একক মাসে সর্বোচ্চ।
২০২২ সালে রেকর্ড সংখ্যক ১১ লাখ ৩৫ হাজার শ্রমিক বিদেশে গিয়েছিলেন, কিন্তু আগের বছরের চেয়ে প্রবাসী আয় কমেছে।
হুন্ডির মাধ্যমে ডলার প্রতি বেশি দর পাওয়ায় মানুষ অনানুষ্ঠানিক উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর দিকে ঝুঁকছে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “সরকার ১১০ টাকায় ডলার বিক্রির দর বেঁধে দিলেও হুন্ডিতে ১১৮ টাকা বা আরও বেশি দরে বিক্রি করছে বলে শোনা যায়। এটি বৈধ উপায়ে প্রবাসী আয় না আসার অন্যতম কারণ।”
ব্যাংক খাতের আরো তিনজন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ প্রায় একই মত দিয়েছেন।
“সরকারের বেঁধে দেওয়া দরে ডলার পাওয়া কঠিন,” মন্তব্য করে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “ডলারের দর বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া যৌক্তিক।”
“এভাবে চলতে থাকলে আমদানিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া সহসাই সম্ভব হবে না। আমদানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে বিনিয়োগ তথা অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হবে এবং তা মূল্যস্ফীতিও উসকে দিতে পারে,” বলেন তিনি।
দেশে ক্রমান্বয়ে কমতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী অবস্থানে রাখতে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বড় ভূমিকা রাখে।
প্রবাসী আয় হ্রাস এবং রপ্তানিতেও প্রত্যাশিত গতি না থাকায় রিজার্ভের ওপর আগামী দিনগুলোতে চাপ আরও বাড়তে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি প্রতিষ্ঠান রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ ১ অক্টোবর প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, গত সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ বাড়লেও তা গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে বাংলাদেশকে চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদনের সময় যে শর্ত বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেছিল, তাতে গত জুনের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার রাখার কথা ছিল।
ওই সময় সংস্থাটির হিসাব মান অনুযায়ী, রিজার্ভ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয় সরকার। এরপর রিজার্ভ আরও নামছে। সর্বশেষ ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, রিজার্ভ ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানির ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব।
‘হুন্ডিতে টাকা পাঠানো সহজ’ ও দাম বেশি
বেসরকারি খাতের এনসিসি ব্যাংক ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন বেনারকে বলেন, “দেশে টাকা পাঠায় মূলত শ্রমিক শ্রেণির লোকজন। হুন্ডিতে পাঠালে হয়তো একটু বাড়তি টাকা পায়, পরিবারের লোকজন সহজে টাকা পায়। এছাড়া যারা পাঠায় তাদের জন্যও বৈধ পথে বা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো ঝামেলার ব্যাপার হতে পারে।”
তিনি বলেন, “রেকর্ড সংখ্যক মানুষ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিদেশে গেছেন, নয়তো এর প্রতিফলন প্রবাসী আয়ে থাকবে না কেন।”
বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর ডলার কেনাবেচার দর ঠিক করে দেয় বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বাফেদা। বর্তমানে ডলার বিক্রির দর ১১০ টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাদের কাছে ডলার আছে, তারা এই দরে ডলার বিক্রি করছে না। পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক ড. আব্দুর রাজ্জাক বেনারকে বলেন, “মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি হয়ে গেছে, ডলারের দাম আরও বাড়বে (টাকার বিপরীতে)। এই প্রত্যাশার কারণেও এখন সরকার দফায় দফায় দাম বাড়ালেও আরও বাড়ছে।”
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “অপ্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে এই ডলার ১১৮ টাকা বা আরও বেশি দরে বিক্রির খবর শুনতে পাই। ফলে বৈধ উপায়ে প্রতিযোগিতা করে ডলার কিনতে পারছে না।”
এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক কড়াকড়ি আরোপ করায় বৈধ উপায়ে ডলার আসা কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশে হুন্ডির মাধ্যমে কী পরিমাণ লেনদেন হয়, তার কোনো তথ্য নেই। তবে প্রবাসী শ্রমিকদের একটি বড়ো অংশই হুন্ডির সঙ্গে জড়িত বলে কথিত আছে।
এই প্রতিবেদকের কাছে দুই জন প্রবাসী শ্রমিক হুন্ডিতে লেনদেন করেন বলে স্বীকার করেছেন। তাদের মধ্যে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী লক্ষ্মীপুর জেলার এক প্রবাসী শ্রমিক বলেন, “ব্যাংকের চেয়ে (সরকারি দর) কিছুটা বাড়তি টাকা পাওয়া যায় বলে হুন্ডিতে টাকা পাঠাই।
“এছাড়া হুন্ডিতে টাকা পাঠানো সহজ, সহজে টাকা পৌঁছে যায়। আমি যার কাছে পাঠাব, তিনি ফোন করে নিশ্চিত করলে আমি টাকা (আমিরাতের স্থানীয় মুদ্রা) পরিশোধ করি।”
উপায় খুঁজবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
এদিকে হুন্ডিতে লেনদেন হচ্ছে কি না সেটি সরাসরি স্বীকার করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বেনারকে বলেন, “হুন্ডির বিষয়ে তো কারও কাছে কোনো তথ্য নেই। এটি অফিসিয়াল নয়, অফিসিয়াল তথ্যই আমাদের বিশ্বাস করতে হয়।”
প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার কারণ খতিয়ে দেখা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলো আমাদের নিয়মিত তথ্য জানায়। আরও কী উপায় (ফরমুলা) বের করা যায়, আমরা দেখব।”
বাড়তি দরে ডলার কেনাবেচা রোধে কিছু প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করাসহ নিজেদের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন তিনি। সর্বশেষ একই অপরাধে গত রোববার (১ অক্টোবর) ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত প্রায় এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের উপরে রয়েছে। সর্বশেষ আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, যা এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
প্রবাসী আয় কম আসায় রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়লে তা আমদানি নিয়ন্ত্রণের বিদ্যমান ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, “আমদানি নিয়ন্ত্রিত হলে জোগান কমে যেতে পারে, যা মূল্যস্ফীতি উসকে দিতে পারে।
বিদ্যুতের জন্য কয়লা, ডিজেল, ফার্নেস অয়েল বা ইউরেনিয়াম আনবো কীভাবে উল্লেখ করে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “অর্থনীতির চাকা ঘুরানো কঠিন হয়ে যাবে।