নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিক্ষোভ থামাতে চুয়েট বন্ধ ঘোষণা
2024.04.25
ঢাকা

বাসের ধাক্কায় দুই সহপাঠীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের লাগাতর আন্দোলন থামাতে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার মধ্যে ছাত্রদের এবং শুক্রবার সকাল ৯টার মধ্যে ছাত্রীদের হল খালি করে দিতে বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন আদেশে বিক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষার্থীরা বৃহস্পতিবার শাহ আমানত পরিবহনের একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেন। তাঁরা জানিয়েছেন, লাইসেন্সবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করাসহ অন্যান্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ক্যাম্পাস ছাড়বেন না।
সর্বশেষ রাত ৯টার দিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্ররা হল ত্যাগ করেননি।
গত ২২ এপ্রিল চট্টগ্রামের আমানত শাহ পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেলে থাকা চুয়েটের দুই ছাত্র শান্ত সাহা (২২) ও তৌফিক হোসাইন (২১) নিহত হন। আহত হন আরেক শিক্ষার্থী জাকারিয়া হিমু (২১)।
ওই ঘটনায় দোষীদের শাস্তি ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ চালিয়ে আসছিলেন।
চুয়েট শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ সাঈদ বেনারকে বলেন, “শাহ আমানত পরিবহনের বাস আমাদের ভাই-বোনদের প্রাণ নিয়েছে। কিন্তু তাদের কোনো বিচার হয়নি। এটি কেমন কথা। একটি বাস ইচ্ছা হলেই ধাক্কা দিয়ে মানুষ মারবে! কিছু হবে না? সারা দেশে প্রতিদিনই রাস্তায় অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। কোনো প্রতিকার নেই।”
তিনি বলেন, “আমরা এই ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা প্রশস্ত করতে হবে, এই সড়কে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, পুলিশ বক্স বসাতে হবে। আমরা যেন নিরাপদে রাস্তায় চলতে পারি সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।”
আব্দুল্লাহ বলেন, কয়েক বছর আগে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর সারা দেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন হলো। কিছু দিন ঠিক থাকার পর আবার সেই একই চেহারা।
বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা যায়নি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে প্রায়ই রাস্তায় নামে দেশের সাধারণ মানুষ।
সবচেয়ে আলোচিত বিক্ষোভ হয় ২০১৮ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে। ২৯ জুলাই ঢাকার শহীদ রমিজউদ্দিন স্কুল ও কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হয়।
ওই ঘটনায় প্রতিক্রিয়ায় রাস্তায় নেমে আসেন সারা দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা। সঙ্গে যোগ দেন অভিভাবকরাও।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে সেই আন্দোলনে প্রায় দুই সপ্তাহ বিচ্ছিন্ন ছিল ঢাকা। ওই ঘটনার পর সড়ক পরিবহন আইন ‘কঠোর’ করে সরকার।
তবে পুরোপুরি বেসরকারি খাতে পরিচালিত গণপরিবহন শ্রমিক-মালিকরা তা বাস্তবায়ন করতে দেননি। পরিবহন ব্যবস্থার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলেই সরকারকে বিপদে ফেলতে ধর্মঘটের ডাক দেয় বাস-ট্রাক মালিক-শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন।
‘পরিবহন খাতে চলছে নৈরাজ্য’
চুয়েট ছাত্রদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা রয়েছে বলে মনে করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক।
বৃহস্পতিবার তিনি বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে। এ জন্য আমি দায়ী করব দেশের অনিয়ন্ত্রিত পরিবহন খাতের শ্রমিক ও মালিকদের। পুরো দেশের পরিবহন সেক্টরে চলছে অরাজকতা ও নৈরাজ্য। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। আহত হয়ে, পঙ্গু হয়ে, মানবেতর জীবন যাপন করছে অসংখ্য মানুষ কিন্তু যেন কারও কিছু করার নেই।”
রিয়াজুল হক বলেন, “চুয়েটের ছাত্ররা যে রাস্তায় নেমেছে, সেটির যৌক্তিকতা আছে। তাদের শিক্ষার্থীরা প্রাণ হারাবে আর তারা বসে থাকবে সেটি হয় না। তবে গাড়ি ভাঙচুর-সহিংসতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এগুলো তো ফৌজদারি অপরাধ।”
তিনি বলেন, “তাদের দাবি নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা, দোষীদের শাস্তি প্রদান এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। সরকারের উচিত এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে দেশের পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা।”
যা বললেন পরিবহন শ্রমিক নেতা
ক্ষমতাসীন দলের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “মনে রাখতে হবে, কোনো চালক ইচ্ছা করে দুর্ঘটনা ঘটান না। দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। দুর্ঘটনার জন্য একজন চালককে ফাঁসি দিতে হবে; এটি তো কোনো দাবি হতে পারে না!”
তিনি বলেন, “দুর্ঘটনা তো শুধু চালকের জন্য হয় না। কখনো রাস্তার ডিজাইনে ত্রুটি, কখনো রাস্তার অবস্থা ইত্যাদির কারণে দুর্ঘটনা হয়। কিন্তু একটি প্রবণতা দেখা যায় যে, দুর্ঘটনা হলেই চালক-হেলপারকে দোষী করা হয়। এটি কি ঠিক?”
গোড়াতেই গলদ
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সাবেক পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) হুমায়ূন রশিদ খলিফা বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তার পথে প্রধান অন্তরায় চালকরা।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের কোনো আইনে বলা নেই যে, পরিবহন খাতের চালক কীভাবে তৈরি হবে। বর্তমান বিধান অনুযায়ী, কেবলমাত্র ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানকারী বোর্ডকে কেউ সন্তুষ্ট করতে পারলেই তিনি পেশাদার চালক হিসেবে লাইসেন্স পাবেন।”
হুমায়ূন রশিদ বলেন, “আমাদের দেশে পেশাদার চালক তৈরি হয় কোনো গাড়ি চালকের জন্য চা বহন করে; হেলপার হিসেবে কাজ করতে করতে। তার কোনো লেখাপড়া নেই। সুস্বাস্থ্য ও বিশ্রামের সুবিধা পান না চালকরা।”
তিনি বলেন, “পেশাদার চালক তৈরির যদি কোনো ব্যবস্থাই না থাকে তাহলে ওই চালকদের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তাসহ দায়িত্ব বোধ জন্মাবে কীভাবে? আর এই ব্যবস্থার মধ্যে যেসব চালক তৈরি হবে, তারাই বা পেশাদার হবে কীভাবে?”
তিনি বলেন, “আইন অনুযায়ী, একজন চালককে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে রাস্তায় তিনি কেমন গাড়ি চালান; চালক হিসেবে রাস্তায় তার আচরণ কেমন; সেটিও পরীক্ষা করার কথা কিন্তু সেটি করা হয় না।”
ফিটনেস প্রদান সম্পর্কে হুমায়ূন রশিদ বলেন বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিআরটিএর পরিদর্শকরা চোখে দেখে একটি যানবাহনের ফিটনেস দেন।
তিনি বলেন, “সড়ক নিরাপত্তার জন্য আরেকটি সমস্যা হলো আইনের প্রয়োগ। রাস্তায় অনেক ফিটনেসহীন যান চলাচল করছে। সেগুলো চলে কীভাবে? যদি আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হতো, তাহলে ফিটনেসহীন গাড়ি এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সহীন চালক গাড়ি চালাতে পারতেন না।”
হুমায়ূন রশিদ বলেন, “আইন বাস্তবায়নের জন্য পুলিশ এবং বিআরটিএর এনফোর্সমেন্ট বিভাগ রয়েছে। আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে সমস্যা থাকত না।”