সড়ক দুর্ঘটনার দায়ে তিন জনের যাবজ্জীবন: সংশ্লিষ্টদের মতে ‘যুগান্তকারী রায়’

পুলক ঘটক
2019.12.02
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
191202_Road_accident_conviction_1000 ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে রায় ঘোষণার পর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া জাবালে নূর পরিবহনের চালক মাসুম বিল্লাহকে পুলিশ পাহারায় কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ১ ডিসেম্বর ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার রায়কে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ ও ‘যুগান্তকারী’ বলে মনে করছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তবে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে এই রায়ের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।

বহুল আলোচিত ওই দুর্ঘটনার দেড় বছরের মাথায় রোববার ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে জাবালে নূর পরিবহনের দুই চালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন এবং সহকারী কাজী আসাদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান বাসের মালিকসহ দুজন।

মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন কারাগারে রয়েছেন, আসাদ পলাতক।

সড়ক নিরাপদ করতে গণমাধ্যম, পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও রাস্তায় দায়িত্বরত ট্রাফিক বিভাগকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করার আহ্বান জানান বিচারক।

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আবু বলেন, “এই রায়ের মাধ্যমে বার্তাটি হচ্ছে, বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে কোনোভাবে পার পাওয়া যাবে না।”

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বেনারকে বলেন, “আদালতের রায় নিয়ে আমাদের কোনও বক্তব্য নেই। তবে শুধুমাত্র মালিক ও শ্রমিকদের শাস্তি দিলেই সড়কে নিরাপত্তা আসবে না। এর সঙ্গে মালিক-চালক-পথচারী সবাই জড়িত। সবার সচেতনতা দরকার।”

“এই রায় একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে,” বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

তিনি বেনারকে বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনায় মামলার ক্ষেত্রে মানুষের আস্থার অভাব আছে। বিচার পাওয়া যায় না বলে অনেকে মামলা করতে চায় না। মামলার তদন্তে দুর্বলতাসহ নানা কারণে সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় এক ধরনের বিচারহীনতা দীর্ঘকাল থেকে চলে আসছে। কিন্তু এবারের এই রায়ের ফলে মানুষের মনে আস্থা ফিরে এসেছে। তাই এটি যুগান্তকারী রায় হিসেবে বিবেচিত হবে।”

এই মামলার রায়কে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে পেছনে ফেলার আরেকটা মাইলফলক’ বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। রোববার নিজ বাসায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “সড়ক পরিবহন আইন এবং মামলার রায়—দুটোই সড়কে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বাসস্ট্যান্ডে জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে বাসচাপায় নিহত হন দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম। আহত হন আরও কয়েকজন।

রাজীব-দিয়ার নির্মম ওই মৃত্যুর প্রতিবাদে এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। নজিরবিহীন ওই ছাত্র আন্দোলনে প্রায় এক সপ্তাহ অচল থাকে ঢাকার সড়ক। ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জেলায়।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন বিল-২০১৮ পাস হয়। এক বছর আগে নতুন সড়ক পরিবহন আইনটি পাস হলেও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বাধার মুখে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অবশেষে গত ১ নভেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়।

তবে আইনটি পুরোপুরি কার্যকরের আগেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সাধারণ মানুষকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এরপর সরকার আইনটির বাস্তবায়নে ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সড়ক পরিবহন আইনটি সংশোধনের ইঙ্গিত দেন।

সড়কে শৃঙ্খলা আসেনি

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও যাত্রীদের অধিকারগুলো এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং সড়কে শৃঙ্খলা আসেনি বলে মনে করেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল।

তিনি বলেন, সড়কে লেন মেনে গাড়ি চালানোর দৃশ্য নেই, আছে শুধু প্রতিযোগিতা করে বাস চালানোর দৃশ্য। সড়কের মাঝখানে যাত্রী ওঠা-নামাও বন্ধ হয়নি।

তবে সার্বিকভাবে আগের তুলনায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ।

বেনারকে তিনি বলেন, “পথচারী ও চালকদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনাটাই এই সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা চালক ও পথচারীদের সচেতন করতে ক্যাম্পেইন করছি। এটা চলমান প্রক্রিয়া। অবস্থার আরও উন্নতি হবে।”

ট্রাফিক পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, “সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য পুলিশের দিক থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এটা চলমান থাকবে।”

বাসগুলোর মধ্যে সড়কে প্রতিযোগিতা বন্ধে নতুন আইন কতটা ভূমিকা রাখবে জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত বাসের ড্রাইভার ও হেলপারের বেতন সু-নির্দিষ্ট করা হবে না এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভাড়া আদায় বাস্তবায়ন করা না যাবে, ততক্ষণ সড়কে পাল্লাপাল্লি কমছে না। হতাশার বিষয়, এ সম্পর্কে নতুন সড়ক আইনে কিছু বলা হয়নি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।