রোহিঙ্গা সংকট: মিয়ানমারকে ‘মিথ্যাচার’ বন্ধ করতে বলল বাংলাদেশ
2019.10.30
ঢাকা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপুলসংখ্যক মানুষ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে মিয়ানমারে গিয়েছিল বলে দেশটির সাম্প্রতিক দাবির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি এ ধরনের ‘মিথ্যাচার’ বন্ধ করে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা পূরণ করার আহবান জানানো হয়েছে।
বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে মিয়ানমারকে সতর্ক করা হয়।
রোহিঙ্গা ঢলের দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেনি মিয়ানমার। উপরন্তু বারবার প্রত্যাবাসনের ব্যর্থতার দায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চাপিয়ে আসছে দেশটি।
তবে সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনের সময় রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন এক দাবি করছে দেশটি।
ন্যামের মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী কিউ তিন বলেন, তাঁর দেশ রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বঞ্চিত করেছে কারণ, এই জনগোষ্ঠী ‘বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী’।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপুলসংখ্যক মানুষ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে মিয়ানমারে গিয়েছিল বলে দাবি করেন তিনি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তোলার উদ্দেশ্যে হঠাৎ করে ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে রাখাইনে যাওয়ার’ নতুন ওই তত্ত্ব আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে মিয়ানমার।
তাঁরা বলছেন, প্রত্যাবাসনের নিয়ে চীনের মধ্যস্থতায় যখন দুই দেশের মধ্যে ঢাকায় আলোচনা হতে যাচ্ছে, তখন মিয়ানমারের এই ধরনের ‘মিথ্যা প্রচারণা’ পুরো প্রক্রিয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এহসানুল হক বেনারকে বলেন, “এটা কখনো আমরা শুনিনি যে বাংলাদেশিরা মিয়ানমারে আশ্রয় নিয়েছিল। যুক্তির খাতির যদি আমরা সেটা ধরেও নিই, তাহলে প্রশ্ন হলো, প্রায় পাঁচ দশক পরে কেন মিয়ানমার এই তথ্য দিচ্ছে?”
“এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ ধরনের মিথ্যা তথ্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাকে জটিল করে তুলবে,” বলেন তিনি।
“মিয়ানমার কোনোভাবেই বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে না। করার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতে আন্তর্জাতিক মহলের বড় ভূমিকা পালন করা উচিত। কিন্তু হতাশার ব্যাপার হলো তারাও সেটা করছে না,” বলেন এহসানুল হক।
মিয়ানমারের এমন দাবির প্রতিবাদে বাংলাদেশ বলেছে, মিয়ানমার সরকারকে অবশ্যই বানোয়াট প্রচারণা বন্ধ করে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় বাধ্যবাধকতা পূরণে মনোযোগী হওয়া উচিত।
রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে যে প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করতে মিয়ানমারকে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও উল্লেখ করে বাংলাদেশ।
কক্সবাজারের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নেতা আবদুর রশিদ বেনারকে বলেন, “একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ রাখাইনে আশ্রয় নিয়েছিল বলে আমাদের জানান নেই। তবে আমরা বাংলাদেশ থেকে যাইনি। আমাদের পূর্ব পুরুষ রাখাইনে বসবাস করে আসছিল। আমাদেরও সেখানেই জন্ম।”
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে নতুন করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিচ্ছে। মিয়ানমারের ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধনের’ অভিযান হিসেবে অভিহিত করেছে জাতিসংঘ।
এদিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও রাখাইনে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমার। ফলে দুই দফা চেষ্টা করেও একজন রোহিঙ্গাকেও রাখাইনে ফেরত পাঠানো যায়নি।
তবে সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে তিন দেশের মন্ত্রীদের বৈঠকে ত্রিপক্ষীয় কমিটি করা হয়। সূত্র বলছে, ঢাকায় বৈঠক করেছে ওই কমিটি। সেখানে প্রত্যাবাসনের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা হয়।
প্রত্যাবাসন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা মিয়ানমারের
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের রাখাইন যাওয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের দাবি প্রত্যাখ্যান করছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে বুধবারের দাবির বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ, তথ্যবিকৃতি এবং ঘটনাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।”
বাংলাদেশ বলছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বানোয়াট প্রচারণা চালিয়ে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে মিয়ানমার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতিমূলক মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী কিউ তিন বলেন, ‘ধর্মীয় নিপীড়ন’, ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ ও ‘গণহত্যার’ মত শব্দ ব্যবহার করে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টিকে বাংলাদেশ ‘ভিন্নভাবে’ চিত্রায়িত করছে বলে অভিযোগ করেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, “মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আলোচনার মাধ্যমেই এ সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দিয়ে আসছে বাংলাদেশ।”
“এই সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার জন্য পুরোপুরিভাবে দায়ী যখন এ ধরনের অযৌক্তিক অভিযোগ তোলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না,” প্রতিবাদে বলেছে বাংলাদেশ।
রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরা এবং সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারকে নিরাপদ ও অনুকূল পরিবেশ তৈরির বিষয়টি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “বহু বছর ধরে চলে আসা এ সংকটের সমাধান যাতে টেকসই হয়, সে জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করতে হবে মিয়ানমারকে।”