বিলুপ্তি থেকে ফেরা ‘রাসেলস ভাইপার’ সাপ এখন আতঙ্ক
2024.05.29
ঢাকা
একটি সাপের কামড় কীভাবে জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে, সে কথাই বলছিলেন গৃহশিক্ষক সাদ্দাম হোসেন (৩৩)। বছর দুয়েক আগে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ফরহাদপুর চরে বিষধর সাপের কামড়ে প্রাণ হারান তাঁর ছোট ভাই সোহেল রানা (২৯)।
সোহেল পাট খেতে কাজ করার সময় প্রথমে সাপে কামড় দেবার বিষয়টি বুঝতে পারেননি জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “কিছুক্ষণ পর সোহেলের পা ফুলে যেতে শুরু করে। তখন আমরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। ডাক্তার জানান যে, ভাইপার কামড় দিয়েছে, অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়। তিন দিন চিকিৎসা নেওয়ার পরে সোহেল মারা যায়।”
সাদ্দাম জানান, তিনি বাবা হারিয়েছেন ছোটবেলায়। সোহেল মিনি ট্রাক চালানোর পাশাপাশি অন্যের জমি চাষ করে মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করতেন। এছাড়া তিনি নিজেও টিউশনি করে প্রায় ১৫ হাজার পেতেন।
“দুই ভাইয়ের আয়ে ভালোই চলছিল আমাদের সংসার। কিন্তু ২০২২ সালে রাসেলস ভাইপার আমাদের জীবন এলোমেলো করে দিলো,” বলেন সাদ্দাম।
সোহেলের মৃত্যু তাঁদের মা (৫২) মেনে নিতে পারেননি জানিয়ে সাদ্দাম বলেন, “তিনি রক্তচাপ ও হৃদরোগে ভুগছেন। একা কীভাবে মায়ের চিকিৎসা করাব, সংসার চালাব বুঝতে পারছি না।”
সোহেলের মৃত্যুর কয়েক দিন আগে একই উপজেলা আলীপুর গ্রামে ২২ বছর বয়সী আরেক যুবকের এই সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, “ছোটবেলা থেকে আমরা সাপটি সম্পর্কে খুব ভালো জানতাম না। গত কয়েক বছরে গোদাগাড়ীতে রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রব বেড়েছে। পদ্মার চরে এই সাপ বেশি দেখা যাচ্ছে। ধান খেতে কাজ করতে গিয়ে কৃষকরা আক্রান্ত হচ্ছেন।”
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কেবলমাত্র বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলেই রাসেলস ভাইপারের দংশনে ২০২ জন ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে ৬২ জন।
চলতি বছরে বৃহত্তর রাজশাহী এবং রাজবাড়ী ও বিভিন্ন জেলায় কমপক্ষে সাতজন রাসেলস ভাইপারের কামড়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
সর্বশেষ গত ২৯ মার্চ রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দেবীপুর চরে ময়না বেগম নামে এক নারীকে ছোবল দেয় রাসেলস ভাইপার। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরার ১৪ দিন পরে তাঁর মৃত্যু হয়।
এদিকে চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার কৃষকরা কমপক্ষে ১০টি রাসেলস ভাইপার মেরেছেন বলে বেনারকে জানান জেলার কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক ড. সাফায়েত আহম্মদ সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, “অনেকে ভয়ে ধান কাটা বন্ধ করে দেন। এই উপজেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে মেঘনা নদী, পদ্মাও মিলিত হয়েছে।”
জেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পর জনগণকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে বলেও জানান সাফায়েত।
রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া
রাসেলস ভাইপার সাপটি ভারতীয় উপমহাদেশের চারটি বড়ো সাপের একটি। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতে কাজ করতে এসেছিলেন স্কটিস সার্জন প্যাট্রিক রাসেল। ১৭৯৬ সালে তিনি এই সাপ সম্পর্কে গবেষণা করেন। তাঁর নাম অনুসারে এই সাপের নামকরণ করা হয়।
বাংলাদেশে এই সাপের অস্তিত্ব ছিল অনেক আগে থেকেই। দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাপটি চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামে পরিচিত। সাপটি দেখতে অনেকটা অজগরের বাচ্চার মতো।
গত বছর ফরিদপুরের চরভদ্রাসন এলাকায় সাপুড়ে সুমন মিয়া একটি সাপ ধরেন। অজগর মনে করে নাড়াচাড়া করার সময় সাপটি তাঁর হাতে কামড় দেয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজে তাঁর মৃত্যু হয়। ওই সাপটি ছিল রাসেলস ভাইপার।
আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী সংঘের (আইইউসিএন), বাংলাদেশ ২০০২ সালে এই সাপটিকে বাংলাদেশে বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
ছড়িয়ে পড়ছে রাসেলস ভাইপার
বাংলাদেশের সাপ গবেষক ও লেখক মো. আবু সাইদ বেনারকে বলেন, ২০০২ সালের পরে এই সাপ বাংলাদেশে আর দেখা যায়নি। ২০১৩ সালে হঠাৎ এই সাপের কামড়ে একজনের মৃত্যু হলে বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপারের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়।
২০১৩ সালের পর থেকে দেশের কমপক্ষে ২৫টি জেলায় রাসেলস ভাইপার সাপ ছড়িয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এটি বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের সাপ হলেও এখন উপকূলীয় অঞ্চল বরিশাল, পটুয়াখালী, চাঁদপুর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।”
তিনি বলেন, এই সাপের কামড়ে মূলত দরিদ্র কৃষক ও অন্যান্য দরিদ্র মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন।
এদিকে সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি তথ্যমতে সারা দেশে প্রতি বছর সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ সাপের কামড়ে প্রাণ হারান বলে জানান আবু সাইদ।
রাসেলস ভাইপার মূলত শুষ্ক অঞ্চলের সাপ, বিশেষ করে এরা বরেন্দ্র এলাকার বাসিন্দা হলেও এখন ছড়িয়ে পড়ছে বলে বেনারকে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও সাপ গবেষক কামরুল হাসান।
তিনি বলেন, “এরা এখন পদ্মা পার হয়ে মেঘনা ও অন্যান্য নদী ধরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এরা খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারে।”
গবেষণা তথ্যমতে বাংলাদেশে এই সাপ যত ধরা পড়েছে অথবা মারা হয়েছে “সেগুলোর শতকরা ৮০ শতাংশ স্ত্রী লিঙ্গের,” জানিয়ে তিনি বলেন, রাসেলস ভাইপার “ডিম পাড়ে না, বাচ্চা দেয়। একবারে ৭০টির বেশি বাচ্চা দেয়।”
তাঁর মতে, কোনো কারণে যদি প্রাকৃতিক শিকারি, যেমন বেজির সংখ্যা কমে যায় তাহলে এই সাপের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এই সাপ ইঁদুর এবং ইঁদুর গোত্রের প্রাণী খেয়ে থাকে। ইঁদুরের সংখ্যা বাড়লেও রাসেলস ভাইপারসহ বিভিন্ন সাপের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।”
কামরুল বলেন, “উত্তরাঞ্চলে সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ প্রতি বছর একসঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে সাপ, ইঁদুরসহ বিভিন্ন প্রাণী শিকার করত। তাতে বিভিন্ন সরীসৃপের সংখ্যায় ভারসাম্য মধ্যে থাকত। এখন তাদের শিকার কমে গেছে।”
চিকিৎসায় নতুন চ্যালেঞ্জ
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবু শাহিন বেনারকে বলেন, “যে অ্যান্টিভেনম (ইনজেকশন) আমরা ব্যবহার করছি, সেটি সব ধরনের সাপে কাটা রোগীদের ব্যবহারের জন্য। এগুলো ভারত থেকে আমদানি করা হয় এবং রোগীদের বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়।”
“সমস্যা হচ্ছে, অন্যান্য বিষধর সাপের কামড়ের চিকিৎসার চেয়ে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা কঠিন ও জটিল। এই সাপের বিষ মানবদেহে একইসঙ্গে অনেক সমস্যা তৈরি করে,” বলেন তিনি।
রাসেলস ভাইপারের বিষের প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্তের “রক্তক্ষরণ হয়, হৃদপিণ্ডের সমস্যা দেখা দেয়, কিডনির কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যায়,” জানিয়ে শাহিন বলেন, “ফলে যেসব রোগী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন, তাঁদের শতকরা প্রায় ৩০ শতাংশ মারা যান। অন্যান্য সাপে কাটা রোগীদের তুলনায় রাসেলস ভাইপারের দংশনে মৃত্যুর হারও বেশি।”
বাংলাদেশের রাসেলস ভাইপার সাপের বিষক্রিয়ার বিপরীতে আরও বেশি কার্যকর “নিজস্ব অ্যান্টিভেনম” প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ভেনম রিসার্চ সেন্টার এই রোগীদের চিকিৎসায় একটি বিশেষ অ্যান্টিভেনম তৈরি করলেও সেটি এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।
এদিকে সাপের কামড়ে প্রকৃতপক্ষে বছরে কতজন মানুষ মারা যায় সেই সঠিক তথ্য “সরকারি সংস্থা থেকে সব সময় পাওয়া যায় না,” বলে জানান গবেষক আবু সাইদ।
এছাড়া, অনেক সময় হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম না থাকায় তা বাইরে থেকে কিনতে হয় বলেও জানান তিনি।
“সরকারের উচিত হবে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় যত দ্রুত সম্ভব অ্যান্টিভেনম তৈরি করে জীবন বাঁচানোর উদ্যোগ নেওয়া,” বলেন তিনি।