রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরে প্রাধান্য পাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.09.06
ঢাকা
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরে প্রাধান্য পাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি মস্কোতে এক বৈঠকের আগে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ (বামে) ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। ২৯ এপ্রিল ২০১৯।
[এপি]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সময়মতো বাস্তবায়ন এবং এই প্রকল্পে রাশিয়ার দেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধের উপায় বের করাসহ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনা করতে ঢাকা আসছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ল্যাভরভই হবেন বাংলাদেশ সফরকারী প্রথম রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তাঁর সফরের সময়ও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ১০ সেপ্টেম্বর ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রনের সফরের তিন দিন আগে তিনি বাংলাদেশে আসছেন, যা রাশিয়ার পশ্চিমাবিরোধী আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ।

পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুম, হত্যাসহ বিভিন্ন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক টানাপোড়েন চলছে।

সের্গেই ল্যাভরভকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে বুধবার ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন বলে বুধবার বেনারকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরিন।

তিনি বলেন, “বৃহস্পতিবারই দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করবেন ল্যাভরভ।”

শুক্রবারই নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকা ত্যাগ করবেন শেখ হাসিনা এবং ল্যাভরভ।”

“রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী কখনো বাংলাদেশ সফর করেননি। ল্যাভরভই প্রথম যিনি বাংলাদেশ সফরে আসবেন।  এই সফরটি দ্বিপাক্ষিক হলেও মূলত এটি রাশিয়ার পশ্চিমাবিরোধী ভূ-রাজনীতির অংশ,” বুধবার বেনারকে জানান সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমশের মবিন চৌধুরী।

8d3683c7-485d-46db-b3bf-e64576907462.jpeg
রাশিয়ার সহায়তায় পাবনার ঈশ্বরদীতে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ করছেন শ্রমিকরা। ৫ মার্চ ২০২৩। [বেনারনিউজ]

গুরুত্ব পাবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান বেনারকে বলেন, “ল্যাভরভের সফর আমাদের জন্য একটি ওয়েলকাম সফর। তাঁর এই সফর প্রমাণ করে বাংলাদেশ বৈশ্বিক শক্তির কাছে রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি বলেন, “এই সফরে আমরা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।  এ ছাড়া জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বহুপাক্ষিক সংস্থায় বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে।”

রাশিয়াকে বাংলাদেশের বন্ধু উল্লেখ করে ফারুক খান বলেন, “ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করতে পদক্ষেপ নিতে রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানাবে বাংলাদেশ।  কারণ আমরা সব ধরনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে।  জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাবনায় রাশিয়ার নাম উল্লেখ করে নিন্দা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেবো না।”

তিনি আরও বলেন, “ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সে ব্যাপারে আমরা তাঁকে অবহিত করব।”

রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয়ের মধ্যে “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ” রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন বলে মনে করেন শমশের মবিন চৌধুরী।

তাঁর মতে, ল্যাভরভের সফরের সময় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও ‘জ্বালানি সহযোগিতা’ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

আলোচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে কীভাবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের জন্য রাশিয়ার দেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ করা যায়, তা থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

এছাড়া “রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি বহনকারী রাশিয়ার জাহাজকে বাংলাদেশের বন্দরে অনুমতি দেওয়ার দাবি করা হতে পারে,” বলেন শমশের মবিন চৌধুরী।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে উল্লেখ করে শমশের মবিন চৌধুরী বলেন, “বিশ্বের প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর নেতারা বাংলাদেশে আসছেন। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে।”

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “আসিয়ানের সদস্য না হওয়ার পরও বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে; রাষ্ট্রপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন।  প্রধানমন্ত্রী জি-২০ সম্মেলনে বিশেষ আমন্ত্রণ পেয়ে ভারত যাচ্ছেন।”

জি২০ সম্মেলনের আগে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে আসছেন এবং জি২০ সম্মেলনের পরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রন ঢাকা আসছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে বিশ্বের দু’টি ক্ষমতাধর দেশের নেতার বাংলাদেশ সফর কূটনৈতিক দৃষ্টিতে খুব তাৎপর্যপূর্ণ।”

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মিত্র ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তবে ১৯৭৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না।

২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগী হয় শেখ হাসিনার সরকার।  এর অংশ হিসেবে রাশিয়ার কারিগরি সহায়তা ও ঋণে পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে রোসাটমের সঙ্গে চুক্তি সই করে বাংলাদেশ।  চুক্তি অনুসারে কেন্দ্র স্থাপনে প্রায় সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে রাশিয়া দিচ্ছে ৯০ ভাগ।

ইউক্রেন আক্রমণের কারণে রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা সুইফট থেকে বের করে দেওয়ার পরে সুদ পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ।

চলতি বছরের শুরুর দিকে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে সুদ পরিশোধে রাজি হয় দুই দেশ, কিন্তু সেটি এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি।

দুই মাস আগে বাংলাদেশে রাশিয়ার এসবার ব্যাংকের একটি শাখা খুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করে রাশিয়া সরকার।  তবে ওই ব্যাংক মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকায় এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।

ঢাকাস্থ রাশিয়ার দূতাবাসের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ-রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশে এক দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে রাশিয়া এবং বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে এক দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।