‘ঈদ মোবারক প্রিয় বাংলাদেশ’: সোমালিয়া থেকে জিম্মি নাবিকের অডিও বার্তা
2024.04.10
ঢাকা
সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যুদের হাতে এক মাস ধরে জিম্মি ২৩ নাবিকের ঈদ কেটেছে দস্যুদের পাহারায়। বাংলাদেশে বৃহস্পতিবার ঈদ উদযাপন হবে, তবে সোমালিয়ায় একদিন আগে বুধবার ঈদ উদযাপন হয়েছে।
জিম্মি নাবিকদের পরিবার ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দস্যুরা তাঁদের ঈদের নামাজ পড়তে দিয়েছেন, নাবিকরা সেমাই রান্না করে খেয়েছেন।
জাহাজটিতে জিম্মি চিফ অফিসার মো. আতিক উল্লা খানের ভাই আব্দুন নুর খান আসিফ বেনারকে বলেন, “ভাই আজকে (বুধবার) ফোন করে জানিয়েছেন, তারা ঈদের দিন সেমাই রান্না করে খেয়েছেন।”
আতিক একটি অডিও বার্তাও পাঠিয়েছেন বলেও জানান আসিফ। অডিও বার্তাটি বেনারের হাতে এসেছে।
দ্রুত এই জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার আকুলতা প্রকাশ করে চার সপ্তাহের বেশি সময় দস্যুদের হাতে আটক এই নাবিক বলেন, “সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে এবং এমভি আব্দুল্লাহ মালিকপক্ষ এসআর শিপিংয়ের আন্তরিক ও তড়িৎ প্রচেষ্টায় খুব শিগগিরই দস্যুদের সাথে মুক্তিপণের বিষয়ে একটি দফারফার মাধ্যমে এই জিম্মিদশার দ্রুত অবসান ঘটবে।”
যদিও আলোচনা কোন পর্যায়ে রয়েছে, সে বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ জাহাজটির মালিকপক্ষ এসআর শিপিং লাইনস।
এসআর শিপিং লাইনসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম বুধবার বেনারকে বলেন, “আমাদের আলোচনা চলছে, অগ্রগতি আছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যাবে না।”
প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আলোচনায় অগ্রগতি আছে। আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে ঈদের পরে।”
অবশ্য মঙ্গলবার সচিবালয়ে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, দস্যুদের হাতে বন্দি নাবিকদের চলতি মাসে সুষ্ঠুভাবে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। যারা দস্যুদের সঙ্গে চলাফেরা করেন, সেই মানুষদের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।”
জাহাজ থেকে বার্তা: ঈদ মোবারক প্রিয় বাংলাদেশ
বার্তায় আতিক উল্লা বলেন, “ঈদে একসাথে কতগুলো প্রিয়মুখ দেখার লোভ আপাতত সামলে নিতে হচ্ছে। …ঈদের পর আবার ঈদ হবে আমাদের প্রিয়জনদের সাথে, প্রিয় মাতৃভূমিতে, প্রিয় বাংলাদেশে।”
তিনি বলেন, “ভালো থাকুক প্রিয়জন, ঈদ মোবারক প্রিয় বাংলাদেশ।”
অডিও বার্তায় মুক্তির অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটানোর কথাও উঠে এসেছে তাঁর জবানিতে।
বেনারের পক্ষ থেকে জিম্মি নাবিক মোশারফ হোসেন শাকিলের ভাই আবু বকর সিদ্দিক, নূর উদ্দিনের স্ত্রীর জান্নাতুল ফেরদৌস ও আতিক উল্লা খানের শ্বশুর মোহাম্মদ ফরিদের সঙ্গে বুধবার কথা হয়। তাঁদের দুইজন জানিয়েছেন, বুধবার (সোমালিয়ায় ঈদের দিন) স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়নি, এর আগের দিন মঙ্গলবার কথা হয়েছে। তাঁরা কারও কারও অসুস্থতার খবরও পেয়েছেন।
নাবিকদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বেনারকে বলেন, “দস্যুরা জিম্মি নাবিকদেরকে জাহাজের মধ্যে ঈদের নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়েছে। গ্রুপের সব নাবিককে একসঙ্গে নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়ার অর্থ হলো, তাদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অবস্থান রয়েছে।”
জাহাজে ঈদের নামাজ পড়ার পর জিম্মি নাবিকদের একটি গ্রুপ ছবি তিনি বেনারের কাছে পাঠিয়েছেন। ওই ছবিতে ২২ জনকে দেখা যায়, যেখানে প্রায় সবাই পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা ছিলেন।
আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে বাংলাদেশি পতাকাবাহী এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি গত ১২ মার্চ সোমালিয়ার উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল গভীর সমুদ্রে ভারত মহাসাগরে দস্যুদের কবলে পড়ে।
বর্তমানে সোমালিয়ার গারাকাদ বন্দরের কাছাকাছি জিম্মি অবস্থায় রয়েছেন ওই জাহাজের ২৩ বাংলাদেশি নাবিক। ছিনতাইয়ের নয় দিন পর গত ২০ মার্চ মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরুর পর দস্যুদের এখনো আলোচনা চলছে।
ঈদের আনন্দ নেই নাবিকদের পরিবারে
বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড়ো ধর্মীয় উৎসব ঈদ বৃহস্পতিবার উদযাপন হতে যাচ্ছে। জিম্মি নাবিকদের পরিবারে কেবলই উৎকণ্ঠা।
মোশারফ হোসেন শাকিলের ভাই চট্টগ্রামের মীরসরাই এলাকার বাসিন্দা আবু বকর সিদ্দিক বেনারকে বলেন, “আমাদের পরিবারে ঈদের আনন্দ নেই। আমার বাবা-মা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করেন। এই অবস্থায় কি কারও ঈদ উদযাপনের সুযোগ আছে?”
জান্নাতুল ফেরদৌস বেনারকে বলেন, “আমাদের ঘরে কোনো ঈদ আসেনি। ঈদের কোনো ব্যস্ততাও নেই। ঈদের কোনো কেনাকাটাও হয়নি, এমনকি আড়াই বছর বয়সী বাচ্চার জন্যও নিজে কিছু কিনিনি।”
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার শাহ মীরপুর লিচুতলা এলাকার এই বাসিন্দা বলেন, “কালকে যে ঈদ, এটি আমার মনে কোনো কাজই করছে না। তারা মুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো আনন্দ নেই।”
‘দস্যুদের সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে’
জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করার বিষয়ে দস্যুদের সঙ্গে জাহাজের মালিকপক্ষের আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী। বেনারকে তিনি বলেন, “আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে হওয়ার কারণে নাবিকদের একসঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে দিয়েছে।”
অডিও বার্তায় মো. আতিক উল্লা খান জিম্মিদশায় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কীভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন তা তুলে ধরেন।
“পরিস্থিতির কারণে সপ্তাহে মাত্র এক দিন এক ঘণ্টা করে পানি ব্যবহার করতেও অভ্যস্ত হয়েছি। প্রায় সময়ই (দস্যুদের) টেস্ট ফায়ারিংয়ের শব্দে পুরো জাহাজ কেঁপে ওঠে; এটাও অভ্যাস হয়ে গেছে। গাদাগাদি করে মেঝেতে রাত কাটানোর অভ্যাসও হয়ে গেছে,” বলেন তিনি।
আতিক আরও বলেন, “আগামী দিনগুলোতে টিকে থাকার পদ্ধতি প্রয়োগ করে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব।”
মঙ্গলবার জাহাজে জিম্মি নূরউদ্দিন তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসের সাথে কথা বলেছেন। জান্নাতুল বেনারকে তিনি বলেন, “সপ্তাহে দুএকবার হয়তো গোসল করতে পারছে। এ কারণে তিনি প্রচণ্ড চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন, “কেবল আমার স্বামী নন, আরও কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, কারও কারও দাঁড়াতে-বসতেও সমস্যা হচ্ছে।”