মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ বিপজ্জনক ও দূষিত জেনেও ভাঙার জন্য ইউরোপের অনেক শিপিং কোম্পানি সেগুলো বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকতে এনে ফেলছে বলে অভিযোগ তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
বৃহস্পতিবার বেলজিয়ামভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান শিপ ব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যৌথভাবে এক প্রতিবেদনে এইচআরডব্লিউ এই তথ্য প্রকাশ করে।
‘মুনাফার জন্য জীবন বেচা-কেনা: কীভাবে জাহাজ শিল্প বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতে বিষাক্ত জাহাজ ভাঙার জন্য প্রবিধান লঙ্ঘন করে’ শীর্ষক ৯০ পাতার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশি জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডগুলো প্রায়ই বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি সমুদ্র সৈকতে ও আশেপাশে ফেলে দেয়।
তারা শ্রমিকের মজুরি, বিশ্রাম ও ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে বলেও অভিযোগ তোলা হয় প্রতিবেদনে।
“জাহাজ ভাঙা কোম্পানিগুলো জীবন ও পরিবেশের মূল্যের বিনিময়ে মুনাফা অর্জন করছে,” মন্তব্য করে এইচআরডব্লিউয়ের গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন,
“শিপিং কোম্পানিগুলোর উচিত আন্তর্জাতিক বিধি-বিধানের ফাঁক-ফোকরগুলো ব্যবহার বন্ধ করা এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেওয়া।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা ও পরিবেশের সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে দেশগুলোর উচিত জাহাজ ভাঙার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক শ্রম এবং পরিবেশগত আইন মেনে চলা।
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য
২০২০ সালে করোনা মহামারির পরে জাহাজ ভাঙার জন্য বাংলাদেশই বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
গত তিন বছরে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক ৫২০টির বেশি জাহাজ ভাঙার কাজে জড়িত ছিলেন, যা বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি, বলা হয় প্রতিবেদনে।
এই প্রতিবেদন তৈরিতে ৪৫ জন জাহাজভাঙা শ্রমিক, তাঁদের স্বজন, ১০ জন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে এইচআরডব্লিউ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাকে (আইএলও) উদ্ধৃত করে সংস্থাটি বলেছে, জাহাজভাঙা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজ। শ্রমিকরা ধারাবাহিকভাবে বলে আসছেন যে, নিরাপদে কাজ করার জন্য তাঁদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দরকার; যা কখনোই দেওয়া হয় না। লোহা গলিয়ে জাহাজ কাটার সময় বিষাক্ত ধোঁয়া এড়াতে শ্রমিকরা তাদের শার্ট মুখে বেঁধে নেন, খালি পায়ে ইস্পাতের টুকরো বহন করেন এবং তাপ থেকে রক্ষায় গ্লাভসের পরিবর্তে নিজেদের মোজা ব্যবহার করেন।
স্বাস্থ্যগত এসব ঝুঁকির কারণে জাহাজভাঙা শিল্পে জড়িত শ্রমিকদের গড় আয়ু বাংলাদেশের অন্যান্য মানুষের চেয়ে অন্তত ২০ বছর কম বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
একজন ৩১ বছর বয়সী শ্রমিক বলেছেন, “আমি যেখানে কাজ করি, সেখানে যদি এক মুহূর্তের জন্যও বিভ্রান্ত বা অন্যমনস্ক হই, তাহলে মুহূর্তের মধ্যেই মারা যেতে পারি।”
নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁর নাম গোপন রাখা হয়েছে বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে।
প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তিতে নিয়োগ খুবই কম
জাহাজভাঙা শ্রমিকদের ওপর করা ২০১৯ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, এই বিপজ্জনক কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের ১৩ শতাংশই শিশু। রাতে কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা ২০ শতাংশ।
এইচআরডব্লিউ যেসব শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রায় ১৩ বছর বয়সে কাজ শুরু করেছিলেন।
শ্রমিকরা জানান, বাংলাদেশের শ্রম আইন লঙ্ঘন করে তাদের বিরতি বা অসুস্থতাজনিত, এমনকি চাকরিরত অবস্থায় আহত হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছুটির আবেদন বাতিল করা হয়।
“শ্রমিকদের খুব কমই প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়, যাতে করে ইয়ার্ড মালিকরা শ্রমিকের মৃত্যু এবং আঘাত আড়াল করে রাখতে পারেন। শ্রমিকরা ইউনিয়ন করার চেষ্টা বা দাবি জানালে তাঁদের বরখাস্ত করা হয় এবং হয়রানি করা হয়,” বলা হয় প্রতিবেদনে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) সভাপতি আবু তাহের বেনারকে বলেন, “এসব অভিযোগ মোটেও সত্য নয়। কারা, কীভাবে এসব প্রতিবেদন করে আমাদের মাথায় আসে না।”
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপমহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাত বেনারকে বলেন, “ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য ও সেফটি সংক্রান্ত বিষয়ে পর্যবেক্ষণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ, পেশাগত ব্যাধির ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিতকরণ, সেফটি কমিটি গঠন ও কার্যক্রম মনিটরিং, স্বাস্থ্যসম্মত প্রক্ষালন ও অন্যান্য সুবিধাদি পর্যবেক্ষণ করা হয়।”
তিনি বলেন, “বিভিন্ন সময় অভিযোগ তদন্ত ও মীমাংসা, দুর্ঘটনার তদন্ত, কাজের সময়সূচি অনুমোদন, নতুন লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, লে-আউট অনুমোদন ও সংশোধন, জরিপ এবং অন্যান্য কারণে বিশেষ পরিদর্শন করা হয় শিপিং ইয়ার্ডগুলোতে।”
নিয়ম এড়াতে ‘সুবিধাজনক পতাকা’ ব্যবহার
আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক আইনে বাংলাদেশের ইয়ার্ডে জাহাজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করার মতো অবস্থা থাকলেও অনেক শিপিং কোম্পানি এসব নিয়ম পাশ কাটিয়ে এবং দোষ এড়ানোর উপায় বের করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকা ব্যবহার করে যাত্রা করা জাহাজগুলোকে ইইউ-অনুমোদিত সুবিধায় ভাঙার নিয়ম রয়েছে; যার কোনোটিই বাংলাদেশে নেই বলে জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়, নিয়ম এড়াতে কোম্পানিগুলো অন্য দেশের ‘সুবিধাজনক পতাকা’ ব্যবহার করে।
২০২২ সালে বিশ্বের মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজের ৩০ শতাংশের বেশি ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর মালিকানাধীন ছিল। যার মধ্যে ভাঙার উদ্দেশ্যে বিক্রয়কৃত জাহাজের সংখ্যা পাঁচ শতাংশেরও কম, বলা হয় প্রতিবেদনে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউরোপিয়ান কমিশনের একজন মুখপাত্র বেনারকে বলেন, “ইইউ’র শিপ রিসাইক্লিং রেগুলেশনের মূল্যায়ন চলছে। ২০১৬ সালের একটি স্টাডি হালনাগাদ করতে কমিশন কাজ করছে। যাতে করে বর্তমান জাহাজ মালিকদের নিরাপদ এবং সঠিক পুনর্ব্যবহারের দিকে আরও উৎসাহিত করা যায়।”
বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের অধিকার ও নানা উন্নয়ন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে চট্টগ্রামভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা)।
এই সংস্থার সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী শাহিন বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের জাহাজ পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হংকং কনভেনশন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার।
“আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিগুলো, বিশেষ করে ইউরোপীয় শিপিং কোম্পানিগুলোর এই শিল্পের বিকাশে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা এবং আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত,” তাগিদ দেন তিনি।
১৮ বছরে ২৫০ শ্রমিকের মৃত্যু
ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) তথ্য অনুসারে, বন্দর নগরী চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে গত ১৮ বছরে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কমপক্ষে ২৪৫ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে গত পাঁচ বছরেই মারা গেছেন ৬২ জন।
ইপসা বলছে, ইয়ার্ডগুলোতে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ২০১৯ সালে মৃত্যু হয়েছে ২২ শ্রমিকের। ২০২০ সালে ১১ জন, ২০২১ সালে ১৪ জন, ২০২২ সালে ১০ জন এবং চলতি বছর এখন পর্যন্ত পাঁচ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
ইয়ার্ডগুলোতে শ্রমিকরা কতটা অমানবিকভাবে কাজ করে তার একটি নমুনা মেলে এইচআরডব্লিউ-এর প্রতিবেদনে দেওয়া ২৮ বছর বয়সী শ্রমিক সাকাওয়াতের (আসল নাম নয়) ভাষ্যে।
২০১৯ সালের ১৯ জুন কাঁধে একটি লোহার বান্ডিল নিয়ে যাওয়ার সময় সাকাওয়াতের পা পিছলে যায়। বান্ডিলটি পড়ে তাঁর ডান পা ভেঙে যায়। তিনি একটি হাসপাতালে যাওয়ার পর সেখানে শেষ পর্যন্ত তার পা কেটে ফেলতে হয়। ইয়ার্ডের মালিকরা তাঁর চিকিৎসার খরচ বহন করতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে পুরো সঞ্চয় ব্যয় করতে হয়। বন্ধুদের কাছ থেকে ঋণও নেন সাকাওয়াত। এখন তিনি গৃহহীন। রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ঘুমান এবং ভিক্ষাবৃত্তি করে বেঁচে আছেন।
ইপসার তথ্যমতে, বাংলাদেশের ১৫০টির মতো জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডে অন্তত ৫০ হাজার শ্রমিক সরাসরি যুক্ত রয়েছেন। বাংলাদেশের ইস্পাতের চাহিদার অর্ধেকেরও বেশি আসে চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক এই শিল্পটি থেকে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) ২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের অর্থনীতিতে এই জাহাজভাঙা শিল্পের বার্ষিক অবদান প্রায় ১৫০ কোটি ডলার।