অত্যাবশ্যক সেবা খাতে নিষিদ্ধ হচ্ছে ‘বেআইনি’ ধর্মঘট
2023.04.06
ঢাকা

জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে সরকার কোনো অত্যাবশ্যক পরিষেবার ক্ষেত্রে ধর্মঘট নিষিদ্ধ করতে পারবে। সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে শাস্তির বিধান রেখে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান।
সরকারের এই উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন, পেশাজীবী, রাজনীতিক ও নাগরিক অধিকারকর্মীরা।
তাঁরা বলছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন উদ্যোগ সন্দেহজনক এবং আইনটি পাশ হলে এর ব্যাপক অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিলটি সংসদে তোলা হলে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
ধর্মঘট করলে কারাদণ্ড ও জরিমানা
অত্যাবশ্যক পরিষেবা বিল, ২০২৩ নামে উত্থাপিত এই প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনি ধর্মঘট শুরু করলে বা চলমান রাখলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
বিলটি সংসদে পাশ হয়ে গেলে, সরকার প্রয়োজনে যেকোনো পরিষেবাকে অপরিহার্য ঘোষণা করতে পারবে বলেও উল্লেখ রয়েছে প্রস্তাবিত আইনে।
আরও বলা হয়েছে, সরকার প্রয়োজন মনে করলে, জনস্বার্থে কোনো প্রতিষ্ঠানে লকআউট (কোনো মালিক কর্তৃক কোনো কর্মস্থল পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ বা কাজ স্থগিত রাখা) ও লেঅফ (কাঁচামালের স্বল্পতা বা মাল জমে থাকা বা যন্ত্রপাতি বিকল হওয়ার কারণে কাজে নিয়োজিত করতে মালিকের ব্যর্থতা) নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে।
১৯৫২ সালের এসেনশিয়াল সার্ভিসেস (মেইনটেন্স) অ্যাক্ট এবং ১৯৫৮ সালের এসেনশিয়াল সার্ভিসেস (সেকেন্ড) অর্ডিন্যান্স রহিত বা বিলুপ্ত করে নতুন এই আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এই আইনটির খসড়া তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ।
তিনি বেনারকে বলেন, “কোভিড-১৯ অতিমারির সময় সরকারের কাছে মনে হয়েছে এই আইনটি সংস্কার প্রয়োজন। সেই বিবেচনায় উদ্যোগ নেওয়া হয়।”
“এই আইনটি পাশ হলে সরকার প্রয়োজন বোধ করলে যে কোনো বেআইনি ধর্মঘটকে নিষিদ্ধ করতে পারবে। তবে হ্যাঁ কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রম আইনের সঙ্গে এই আইনটি সাংঘর্ষিক,” বলেন শ্রম বিষয়ে অভিজ্ঞ এই আইনজীবী।
সংসদে উত্থাপিত বিল অনুযায়ী, শ্রম আইনের সঙ্গে কোনো বিষয়ে সাংঘর্ষিক মনে হলে এই আইনের বিধান প্রাধান্য পাবে।
প্রস্তাবিত আইনে উল্লিখিত অত্যাবশ্যক পরিষেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে: ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ ক্ষেত্র, স্থল, রেল, জল ও আকাশপথে পরিবহন, বিভিন্ন বন্দর থেকে পণ্য বোঝাই ও খালাস, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো পরিষেবা, খাদ্যদ্রব্য, পানি, পয়োনিষ্কাশন, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কয়লা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ইস্পাত, সার, তেলক্ষেত্র, তেল শোধনাগার, টাকশাল ও নিরাপত্তামূলক মুদ্রণ কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো পরিষেবা।
কিছু ক্ষেত্র বিবেচনায় সরকার চাকরি বা চাকরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো পরিষেবাকে অত্যাবশ্যক পরিষেবা হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে বলেও উল্লেখ রয়েছে প্রস্তাবিত আইনে।
‘ধর্মঘটের অধিকার যেন ক্ষুণ্ণ না হয়’
সরকার এমন এক সময় আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে যখন চলতি বছরের ডিসেম্বরে অথবা আগামী বছরের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “তথাকথিত বিশেষ পরিস্থিতিতেও যেকোনো সেক্টরে ধর্মঘটের অধিকার সাময়িকভাবে সীমিত করার জন্য এই ধরনের আইন প্রণয়নের জন্য একটি ধারাবাহিক উন্মুক্ত, পদ্ধতিগত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।”
আলোচনার মাধ্যমেই এটা ঠিক করে নিতে হবে দাবি করে তিনি বলেন, “অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ করে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, অত্যাবশ্যক পরিষেবাগুলোর নিরবচ্ছিন্ন বিতরণের নামে ধর্মঘটের অধিকার কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ করা হবে না।”
“এই জাতীয় আইনের মূল শর্তগুলো অবশ্যই সুনির্দিষ্টভাবে এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত, যাতে দলীয় এজেন্ডাসহ যে কোনো স্বার্থের প্রয়োজনে অপব্যবহারের বাইরে রাখা যায় আইনকে। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে আইনের এমন অপপ্রয়োগ অস্বাভাবিক নয়,” বলেন ইফতেখারুজ্জামান।
যেহেতু সামনে জাতীয় নির্বাচন এবং নানা ক্ষেত্রে সরকার অধিকার খর্বের ঘটনা ঘটিয়েছে, সেহেতু এই সময়ে এই আইন প্রণয়ন জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “খসড়াটি বাংলাদেশের সাংবিধানিক বিধান এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা মূল্যায়ন করার জন্য পর্যাপ্ত সময় এবং সুযোগ দেওয়ার জন্য জনসাধারণকে যাচাই-বাছাই করার সুযোগ দেওয়া উচিত।”
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. এহতেশামুল হক চৌধুরী বেনারকে বলেন, “অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য চিকিৎসক ও নার্সরা বিক্ষোভ করে থাকেন। অত্যাবশ্যক পরিষেবার নামে প্রতিবাদের মৌলিক অধিকার নিষিদ্ধ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”
“সংবিধান প্রতিবাদ করার অধিকার দেওয়ার পরও যদি সংসদ এ ধরনের আইন পাশ করে, আমরা তা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যাব,” বলেন এই চিকিৎসক নেতা।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আশিকুল আলম চৌধুরী বলেন, “বিলটি সংসদে উত্থাপনের আগে অংশীজনের সঙ্গে কোনো আলোচনা না হওয়ায় শ্রমিকরা এ ধরনের পদক্ষেপের সঙ্গে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করবে।”
শ্রমিক অধিকারের পরিপন্থী কিছু হলে শ্রমিকরা এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি ডাকবেন বলেও জানান তিনি।
এক বিবৃতিতে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, “ক্ষমতাসীন অগণতান্ত্রিক সরকার দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা করছে।”
বর্তমান সরকার চূড়ান্ত স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করতে চায় দাবি করে তিনি বলেন, “বিরোধী মতকে দমন করার জন্য তারা একের পর এক অসাংবিধানিক আইন চালু করছে। জনগণের বাক স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক কালো আইন তৈরি করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের নির্দেশে ধর্মঘট বন্ধ করার আইন পাস করার পাঁয়তারা করছে।”