বুয়েট শিক্ষার্থী হত্যায় উপাচার্য অবরুদ্ধ, ক্ষোভ সর্বত্র

জেসমিন পাপড়ি
2019.10.08
ঢাকা
বুয়েট শিক্ষার্থী হত্যায় উপাচার্য  অবরুদ্ধ, ক্ষোভ সর্বত্র বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতে তোলা হয়। সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৯।
নিউজরুম ফটো।

মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদে এবং নয় দফা দাবিতে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলামকে অবরুদ্ধ করে রাখে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে তালা খুলে উপাচার্যকে তাঁর কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

রাত এগারোটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে আন্দোলনকারি শিক্ষার্থীরা বুধবারও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

আবরারকে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে মঙ্গলবার বুয়েটের আরও তিন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এই নিয়ে এ ঘটনায় ১৩ জনকে গ্রেপ্তার হলো, যাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট।

গত সোমবার ভোরের দিকে ছাত্রলীগের কর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করে আবরারকে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় সম্পাদিত পানি চুক্তিসহ অন্যান্য চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়।

এ প্রসঙ্গে প্রবীণ শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বেনারকে বলেন, “মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর এটা বড় ধরনের আঘাত। এতোদিন আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের কথা বলে আসছিলাম। এখন এই স্বাধীনতার ওপর রীতিমতো আক্রমন করা হচ্ছে, যার শিকার বুয়েটের মেধাবী ছাত্রটি।”

নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের দুদিন পর শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ক্যাম্পাসে হাজির হয়ে মঙ্গলবার তোপের মুখে পড়েন উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ‘নীতিগত সমর্থন’ জানালেও তাদের দাবির বিষয়ে ভিসি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য না দেওয়ায় প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা তাঁকে অবরুদ্ধ রাখে শিক্ষার্থীরা। এ সময় উপাচার্যের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন তাঁরা।

এ ঘটনায় নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগ। জুয়া ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে দলীয় নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ের মধ্যে আবরার হত্যায় ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতায় কিছুটা বিব্রত অবস্থায় পড়েছে ক্ষমতাসীন দল।

২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে​ জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। দেশের প্রধান বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের নিজেদের কোন্দলে নিহত হয় ৩৯ জন, এ সময় ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে প্রাণ হারান অন্য সংগঠনের ১৫ জন। গড়ে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনও না কোনও কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা হামলা, সংঘর্ষ বা মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছেন।

এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লিখন ভট্টাচার্য বেনারকে বলেন, “কেউ অন্যায় বা অপরাধ করলে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। বুয়েটে যারা হত্যায় জড়িত থাকার জন্য অভিযুক্ত, প্রত্যেককে বহিষ্কার করা হয়েছে, ছাত্রলীগ ঘটনার বিষয়ে তদন্ত কমিটি করেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকেও সহায়তা করতে প্রস্তুত ছাত্রলীগ।”

বুয়েটের এই ঘটনার পর ছাত্ররাজনীতি নিয়ে নতুন করে বির্তক সৃষ্টি হয়েছে। খোদ সাধারণ ছাত্ররাই বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন। তাঁদের নয় দফা দাবির মধ্যে এটি ​অন্যতম দাবি।

তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, ছাত্র রাজনীতি নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দৌরাত্ম বন্ধ করতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলী আর রাজী বেনারকে বলেন, “ক্ষমতাসীনদের দলের হস্তক্ষেপের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সঠিক রাজনীতির চর্চা নেই।”

“যারা অপরাধ ও নানা অপকর্ম করে তারা ক্ষমতাসীন দলের বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন নেয়। এর সাথে ছাত্র রাজনীতির সম্পর্ক নেই। এরা ক্যাম্পাসে আধিপত্য বজায় রাখার মাধ্যমে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ হলের আবাসন ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে,” বলেন তিনি।

আটক আরও তিনজন, রিমান্ডে দশজন

হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মঙ্গলবার বুয়েটের আরও তিন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বেনারকে জানান, “আটক এই তিনজনই নিহতের বাবার দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। এরা হচ্ছে; মনিরুজ্জামান মনির (২১), মো. আকাশ হোসেন (২১) ও শামসুল আরেফিন রাফাত (২১)। তারা বুয়েটের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী।

ওই ঘটনায় রাজধানীর চকবাজার থানায় ১৯ জনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন আবরারের বাবা বরকতুল্লাহ।

পুলিশ জানায়, দুই দিনে এজাহাভুক্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জনকে মঙ্গলবার আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশের আবেদনের ভিত্তিতে প্রত্যেককে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেয় আদালত। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার পুলিশের অভিযান চলছে বলে জানান মাসুদুর রহমান।

আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় চকবাজার থানায় দায়ের করা মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও নিশ্চিত করেন তিনি।

জিজ্ঞাসাবাদে আরও তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন। তিনি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা আবরারকে ডেকে এনে পিটিয়ে হত্যার কথা স্বীকার করেছে।”

প্রতিবাদে ফুঁসছে দেশ

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় কুষ্টিয়ার কুমারখালীর রায়ডাঙ্গা গ্রামের আবরার ফাহাদকে দাফন করা হয়। সেখানে তাঁর জানাজায় হাজারো মানুষের ঢল নামে।

মেধাবী এই শিক্ষার্থী হত্যায় জড়িতেদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি ছিল সবার চোখে মুখে।

আবরার হত্যার প্রতিবাদের আন্দোলনে নামা বুয়েট শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও। বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ কে এম মাসুদ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।”

বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শনাক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়ায় আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ বুয়েট শিক্ষক সমিতির।

এক বিবৃতিতে শিক্ষক সমিতি জানায়, “আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের শিকার হওয়া ও মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। একাডেমিক ভবন ও আবাসিক হলগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। আবরার হত্যার ঘটনা প্রমাণ করেছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।”

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে আমরা ক্ষুদ্ধ, ব্যথিত ও মর্মাহত। এই হত্যাকাণ্ড নির্মম ও পৈশাচিক।”

এই হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল হচ্ছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের অন্তত ১৫টি জেলা শহরে মানববন্ধন, মিছিল, মোমবাতি প্রজ্বলন ও অবরোধ কর্মসূচী পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা।

বুয়েট শিক্ষার্থীদের নয় দফা দাবি

বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নয় দফা দাবি জানিয়েছে। এগুলো হলো; খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের শনাক্ত করে সবার ছাত্রত্ব আজীবন বহিষ্কার করতে হবে ও দায়েরকৃত মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অধীনে স্বল্পতম সময়ে নিষ্পত্তি করতে হবে।

অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে; বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কেন ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি, এ বিষয়ে তাঁকে সবার সামনে জবাবদিহি করতে হবে। আবাসিক হলগুলোতে র‍্যাগের নামে ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধে জড়িত সবার ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে।

রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সাধারণ ছাত্রদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ক্যাম্পাসে ক্ষমতাকেন্দ্রিক সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে।

এসব দাবিতে অবরুদ্ধ উপাচার্য মুক্তি পাওয়ার এক থেকে দেড় ঘন্টার মধ্যেই দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। রাত এগারোটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডীন উপাচার্যের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জানান যে, কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের সব দাবি মেনে নিয়েছে। আন্দোলনকারি ছাত্ররা বুধবার জড়ো হওয়ার পর তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।