বাংলাদেশে প্রথম সাবমেরিন ঘাঁটি চালু

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.03.20
ঢাকা
বাংলাদেশে প্রথম সাবমেরিন ঘাঁটি চালু কক্সবাজারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডুবোজাহাজ ঘাঁটি উদ্বোধনের সময় স্যালুট করছেন নৌবাহিনীর সদস্যরা। জেটির দুই পাশে সাবমেরিন দুটি দেখা যাচ্ছে। ২০ মার্চ ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

চীন থেকে দুটি সাবমেরিন কেনার প্রায় সাড়ে ছয় বছর পর কক্সবাজারের পেকুয়ায় নির্মিত দেশের প্রথম সাবমেরিন ঘাঁটি চালু করল বাংলাদেশ।

সোমবার গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এক দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ টাকায় নিজ নামে নির্মিত ‘বানৌজা শেখ হাসিনা’ ঘাঁটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই ঘাঁটি চালুর ফলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য ২০১৬ সালের নভেম্বরে চীনের কাছ থেকে কেনা ‘নবযাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা’ নামে সাবমেরিন দু’টি রাখার যথাযথ স্থান নির্মিত হলো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবমেরিন কেনা ও ঘাঁটি নির্মাণের ফলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আধুনিকায়ন তরান্বিত হলো।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা কারো সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাই না। কিন্তু যদি কেউ আমাদের আক্রমণ করে তার সমুচিত জবাব দেবার প্রস্তুতি আমাদের থাকবে এবং আজ এই সাবমেরিন ঘাঁটি দেখে আমার এই প্রত্যয় আরও সুদৃঢ় হয়েছে।”

বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে উঁচু স্থানে অবস্থিত হওয়ার পরও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আধুনিকায়ন তেমন গুরুত্ব পায়নি বলে আসছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

তবে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর বাংলাদেশের এক লাখ ১৮ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বেশি সমুদ্র অঞ্চল রক্ষার জন্য নৌবাহিনীর আধুনিকায়নের বিষয়টি সামনে চলে আসে।

তারই অংশ হিসেবে ২০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে চীন থেকে পুরানো দুইটা সাবমেরিন কেনে বাংলাদেশ।

চীন থেকে সাবমেরিন কেনায় ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে অনেকেই বলেন, বাংলাদেশ ভারতের পরিবর্তে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারও সাথে বৈরিতা নয়’নীতিতে চলছে। বাংলাদেশ কারো পক্ষে নয়, নিজেরে জাতীয় স্বার্থের দিকে।

সাবমেরিন দুটির জন্য ঘাঁটি নির্মাণেও চীন সহায়তা করে বলে এর আগে বেনারকে জানিয়েছিলেন সরকারি কর্মকর্তারা।

দেশের ইতিহাসে বড়ো ঘটনা

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ সোমবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে সাবমেরিন সংযোজন দেশের ইতিহাসে একটি বিরাট ঘটনা।”

তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ চীন থেকে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কিনে থাকে। এর অন্যতম কারণ হলো আমেরিকা এবং অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের কাছে সচরাচর এসব সামগ্রী বিক্রি করতে চায় না। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে।”

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, “চীন সাবমেরিন দিতে রাজি হয়েছে বিধায় বাংলাদেশ কিনেছে।”

“প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর বিরাট একটি সামুদ্রিক অঞ্চল পেয়েছে বাংলাদেশ। এই অঞ্চলে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সাবমেরিন সংযোজন নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে,” বলেন তিনি।

মেজর জেনারেল রশীদ আরও বলেন, “বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে, বিভিন্ন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ এবং বিভিন্ন ননট্রেডিশনাল নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা করতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সক্ষমতা অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে।”

সাবমেরিনের বৈশিষ্ট্য কী?

২০১৭ সালের ১২ মার্চ এই সাবমেরিন ঘাঁটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন শেখ হাসিনা। ওই দিন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, চীন থেকে সংগ্রহকৃত এই সাবমেরিন দু’টি কনভেনশনাল ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিন যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৭৬ মিটার এবং প্রস্থ সাত দশমিক ছয় মিটার।

সাবমেরিন দু’টির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় প্রায় ১৭ নটিক্যাল মাইল এবং ডিসপ্লেসমেন্ট এক হাজার ৬০৯ টন। টর্পেডো ও মাইন অস্ত্রে সজ্জিত এই সাবমেরিন দু’টি শত্রু জাহাজ ও সাবমেরিনে আক্রমণ করতে সক্ষম।

এছাড়া এই সাবমেরিনগুলো শত্রু জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণসহ বিশেষ যুদ্ধকালীন দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম। আধুনিক সাবমেরিন দু’টি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নৌবাহিনীর বহরে সংযোজিত হয় বলে জানানো হয়।

সাবমেরিন দু’টি নৌবহরে সংযোজনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ত্রি-মাত্রিক বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বলে জানায় আইএসপিআর।

আনুষ্ঠানিকভাবে এই সাবমেরিন দু’টি নৌবহরে অন্তর্ভুক্তির ফলে দেশের বিশাল জলসীমার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সার্বিক সক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ব্লকগুলোতে অধিকতর নিরাপত্তাসহ সার্বিকভাবে দেশের ‘ব্লু-ইকোনমি’ উন্নয়নে এই সাবমেরিন দু’টি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

১৪ বছরে ৩১ যুদ্ধজাহাজ

সাবমেরিন ঘাঁটি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা জানান, তাঁর সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ অনুসারে সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক ও সময়োপযোগী হিসেবে রূপান্তরের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, “গত ১৪ বছরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বহরে চারটি ফ্রিগেট, ছয়টি করভেট, চারটি বড় পেট্রোল ক্র্যাফট, পাঁচটি পেট্রোল ক্র্যাফট এবং দু’টি প্রশিক্ষণ জাহাজসহ মোট ৩১টি যুদ্ধজাহাজ যুক্ত হয়েছে। আর সামরিক শক্তিতে বাংলাদেশের নতুন মাইলফলক হলো এই সাবমেরিন ঘাঁটি।”

“আজ আমাদের নৌবাহিনী একটি ত্রি-মাত্রিক নৌবাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,” বলেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশ বর্তমানে স্থানীয় শিপইয়ার্ডে নিজের এবং অন্যদের ব্যবহারের জন্য জাহাজ নির্মাণ করছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী খুলনা শিপইয়ার্ডে একটি বড়সহ পাঁচটি পেট্রোল ক্রাফট নির্মাণ সম্পন্ন করেছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।