অনলাইন থেকে তারেক রহমানের বক্তব্য সরাতে হাইকোর্টের নির্দেশ
2023.08.28
ঢাকা
বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সব বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সরানোর নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
এই আদেশকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে বিচারপতিরা এজলাস ছেড়ে খাস কামরায় চলে যান। এতে বিচারকাজ বন্ধ হয়ে যায়।
সোমবার বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেওয়ার সময় তারেক রহমানের আইনজীবীরা আদালতে জ্যেষ্ঠ বিচারপতির উদ্দেশে বলেন, আপনার প্রতি আমাদের অনাস্থার বিষয়টি প্রধান বিচারপতি বরাবর দিয়েছি। বিষয়টি আপনি জানেন। এই অবস্থায় আপনি এ বিষয়ে আদেশ দিতে পারেন না।
এ সময় আইনজীবীরা শেম শেম বলে চিৎকার করেন। সকালে সাড়ে ১০টা থেকে সোয়া ১১টা পর্যন্ত আইনজীবীদের ব্যাপক হট্টগোল ও চিৎকারের একপর্যায়ে বিচারপতিরা এজলাস কক্ষ ত্যাগ করেন।
আদালতে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক মাহবুবউদ্দিন খোকন, বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক বদরুদ্দোজা বাদল ও রুহুল কুদ্দুস কাজল বক্তব্য রাখেন।
শুরুতে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, “আমরা আপনার বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির কাছে অনাস্থা জানিয়েছি। আপনি বায়াসড, পক্ষপাতদুষ্ট। আপনার কাছ থেকে আমরা ন্যায় বিচার পাব না। এ কারণে আপনার কোর্টে তারেক রহমানের কোনো মামলা চলতে পারে না।”
এ সময় বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান বলেন, “আপনারা আমার কথা শোনেন।”
তখন সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, “আপনি তো আবেদন শোনেননি। আপনি শুনানি না করেই ৩০ সেকেন্ড সময় নিয়ে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আদেশ দিলেন। এটা আপনি করতে পারেন না। কোর্টের পরিবেশকে আপনি নষ্ট করে দিচ্ছেন। আপনি ইনজাস্টিস করছেন।”
কাজলের বক্তব্যের পরপরই ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, “আমাদের বক্তব্য আপনার শুনতে হবে। আমাদের বক্তব্য না নিয়ে কোনো অর্ডার পাস করতে পারেন না। আপনি কি তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নীল-নকশার রায় দেওয়ার জন্য বসেছেন? আপনি বিচার বিভাগে অরাজকতা সৃষ্টি করছেন।”
এরপর বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান বলেন, “আমাদের আদেশের বিরুদ্ধে আপনারা আপিল বিভাগে যেতে পারেন।”
বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা তাঁকে পক্ষপাতদুষ্ট বিচারক বলে চিৎকার করতে থাকেন। কোর্টে উপস্থিত আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টি না করার আহ্বান জানাতে থাকেন।
সোয়া ১১টায় বিচারপতিরা আদালত কক্ষ ত্যাগ করলেও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আদালত কক্ষে অবস্থান করেন। দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত আদালতে অবস্থান করে তাঁরা চলে যান।
ফেসবুক-ইউটিউব থেকে তারেকের বক্তব্য সরানোর নির্দেশ
সকাল সাড়ে ১০টায় আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে তারেক রহমানের বক্তব্য ফেসবুক-ইউটিউব থেকে সরানোর নির্দেশনা চেয়ে আবেদন গ্রহণ করে হাইকোর্ট বেঞ্চ।
তারেকের বক্তব্য ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে অপসারণ করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) পদক্ষেপ নিতে আদেশ দেয় আদালত।
এর আগে তারেকের বক্তব্য প্রচার বন্ধে দায়ের করা রিটে সম্পূরক আবেদন করে বক্তব্য অপসারণ করতে নির্দেশনা চাওয়া হয়।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আইনজীবী কামরুল ইসলাম ও আইনজীবী সানজিদা খানম এ আবেদন উপস্থাপন করেন।
আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাসরিন সিদ্দিকা লিনা এ আবেদনটি করেছিলেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
যা বললেন দুই পক্ষের আইনজীবী
আদালত থেকে বের হয়ে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল সাংবাদিকদের বলেন, “কয়েক দিনের কার্যক্রমে মনে হয়েছে, প্রিসাইডিং জজ পক্ষপাতদুষ্ট। তাই প্রধান বিচারপতি বরাবর একটি দরখাস্ত দিয়েছি। আবেদনে মামলাটি অন্য আদালতে স্থানান্তর করার জন্য বলেছি।”
অন্যদিকে রিট আবেদনের পক্ষে থাকা আইনজীবী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “তারা (বিএনপিপন্থী আইনজীবী) অযাচিতভাবে কোর্টের কার্যকলাপকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছেন। তারা কোনোভাবে পার্টি নন (মামলায় পক্ষভুক্ত না)। তারা এত উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছে, যে কারণে আদালত নেমে গেছে। এটা আদালত অবমাননার শামিল।”
এর আগে গত ১৩ আগস্ট প্রিন্ট, ইলেকট্রিক মিডিয়া ও অনলাইন গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বক্তব্য প্রচার বন্ধ করা বিষয়ে জারি করা রুলের নোটিশে তারেক রহমানের ঠিকানা ভুল থাকায় তা সংশোধন করে তারেক রহমানের গুলশানের ঠিকানায় নোটিশ পাঠানোর নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
এ মামলার শুনানি নিয়ে গত ৮ আগস্ট আদালতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোলের ঘটনা ঘটে।
তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচার নিয়ে ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন এ আদেশ দেন।
রায় প্রত্যাখ্যান বিএনপির
তারেক রহমানের বক্তব্য সব অনলাইন থেকে সরাতে হাইকোর্টের আদেশ প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি।
আদালতের আদেশের পর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “এটা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা পূরণের রায়।”
তিনি বলেন, “আমি এই আদেশের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং প্রত্যাখ্যান করছি দলের পক্ষ থেকে এই অবিচারমূলক রায়।”
কয়েকটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা তারেক রহমান গত ২৮ জুলাই ঢাকায় দলের একটি মহাসমাবেশে প্রথমবারের মতো লন্ডন থেকে যুক্ত হয়ে অডিও বার্তায় বক্তব্য রাখেন।
তারেক রহমানের ওই বক্তব্যের পর দেশের রাজনীতিতে বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “এটা পরিষ্কার যে তারেক রহমানের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে সরকার আদালতকে ব্যবহার করছে। তারেক রহমানের বক্তব্যে দেশে যে আলোড়ন তৈরি হয়েছে তাতে সরকার বিচলিত।”
এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “একজন পলাতক আসামিকে নিয়ে বিএনপির হই চই প্রমাণ করে তাঁদের নেতৃত্বের বিশাল সংকট চলছে। এখন তারা আদালতকেও অসম্মান করছে।”