বিশ্লেষণ: তারেক রহমানের দেশে ফিরতে দেরি হচ্ছে কেন?

শরিফুজ্জামান পিন্টু
2024.11.08
ঢাকা
বিশ্লেষণ: তারেক রহমানের দেশে ফিরতে দেরি হচ্ছে কেন? লন্ডনের একটি পার্কে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩। [এএফপি]
[এএফপি]

আপডেট: ৯ নভেম্বর ২০২৪। ইস্টার্ন সময় সকাল ১০:২৫।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা বিলম্বিত হবার পেছনে তাঁর সাজা ও চলমান মামলাগুলো নিয়ে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ‘পক্ষের’ অবস্থান ‘সুস্পষ্ট’ না থাকাকে কারণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

তবে কারো কারো মতে, খালেদা জিয়ার বিদেশ যাবার সিদ্ধান্তের সাথেও তারেক রহমানের দেশে ফেরা বিলম্বের সম্পর্ক রয়েছে।

উন্নত চিকিৎসার জন্য ৭৯ বছর বয়সী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গন্তব্যস্থল হিসেবে আলোচনায় বিভিন্ন দেশ ও স্থানের নাম থাকলেও আকস্মিকভাবে এখন লন্ডনের নাম এসেছে, যেখানে তাঁর পুত্র তারেক রহমান দেড় দশকের বেশি সময় ধরে অবস্থান করছেন।

খালেদা জিয়াকে বিদেশ নেবার “প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে” জানিয়ে শুক্রবার তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “প্রথমে তিনি লন্ডনে যাবেন এবং সেখান থেকে আমেরিকা অথবা জার্মান যেতে পারেন।”

তাঁর যাত্রার তারিখ এখনো চূড়ান্ত না হলেও তা খুবই ‘শিগগির’ হবে বলে জানান জাহিদ হোসেন।

দীর্ঘদিন পর লন্ডনে মা-ছেলের দেখা হতে যাচ্ছে। তাই খালেদা জিয়া বিদেশ থাকা অবস্থায় তারেকের দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেছেন বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা।

তারেক “কবে দেশে আসবেন, সেই ধারণা তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি,” বলে বেনারকে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।

বিএনপির নেতা-কর্মীরা তারেকের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ফেরার মতো ‘পরিবেশ’ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারেকের দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম।

“দেশে আসার জন্য যে পরিবেশ দরকার সেটি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারেক আসবেন না, এটাই স্বাভাবিক,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া।

এদিকে তারেকের ফিরে আসার ‘পরিবেশ’ বিষয়ে দু ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে বিএনপির নেতাদের কাছে। তাঁরা একবার বলছেন, আওয়ামী সরকারের আমলে সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তারেক দেশে ফিরবেন না। অন্যবার বলছেন, তারেকের ফিরে আসা নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।

image_6483441.JPG
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ঢাকার একটি আদালতে হাজিরা দেবার সময় সমর্থকদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। ১৯ অক্টোবর ২০১৭। [বেনারনিউজ]

ফেরার পরিবেশ তৈরি ‘সরকারের দায়িত্ব’

আওয়ামী লীগ শাসনামলের গত দেড় দশকে সারা দেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের প্রায় দেড় লাখ মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ বলে বেনারকে জানান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন।

তিনি বলেন, “যেহেতু তারেক রহমানের নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় তাঁরা আন্দোলন করেছেন, মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন, অন্যায় কারাভোগ করেছেন; সেহেতু ওনার কাছে সব ত্যাগী নেতা-কর্মী তথা নিপীড়িত জনগণের মামলা প্রত্যাহার বা শেষ করাটাই অগ্রাধিকার।”

বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো সুরাহা হবার পরেই তারেক দেশে ফিরতে চান বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেছেন বিএনপির অন্তত পাঁচজন কেন্দ্রীয় নেতাও।

তবে তারেকের নিজের দণ্ড ও মামলাগুলো নিয়ে এখন পর্যন্ত “দেশি-বিদেশী পক্ষগুলোর” অবস্থান “সুস্পষ্ট” না থাকা তাঁর ফিরতে বিলম্ব হবার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া।

আইনজীবীদের তথ্য অনুযায়ী, তারেকের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ১১৩। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু মামলা খারিজ বা প্রত্যাহার হয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় যাবজ্জীনসহ তারেকের সাজা হয়েছে চারটি মামলায়।

তবে তারেক রহমান “নিজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলাগুলো নিয়ে নয়, দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভাবছেন,” উল্লেখ করে মাহদী আমিন বলেন, “তাঁর দেশের ফেরার জন্য রাজনৈতিক ও আইনি পরিবেশ তৈরি করা এই অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব।”

‘আদালতের দৃষ্টিতে ফেরারি’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তারেকের দেশে না ফেরার নেপথ্যে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।

তাঁদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকার পতন আন্দোলনে যেসব পক্ষ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে তাঁদের অনেকে তারেক রহমানকে প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নিতে চান না।

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, একথা সত্য যে, আন্দোলনকারীরা একাধিকবার বলেছেন, তারা আন্দোলন করেছেন কোনো দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য নয়।

বিএনপির সকল নেতা-কর্মীর মামলা প্রত্যাহার করার পরে তারেক দেশে ফিরবেন বলে যে কথাটি বলা হচ্ছে, তাকে “আলঙ্কারিক” আখ্যায়িত করে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, তারেক চারটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় “আদালতের দৃষ্টিতে ফেরারি বা পলাতক।”

“তারপরও রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব মামলা খারিজ বা প্রত্যাহার হতে পারে,” যোগ করেন তিনি।

তারেক রহমানের সম্মতি পেলে সরকারের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা প্রয়োগ করে তাঁর সাজা স্থগিতের আবেদন করা হবে বলে সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানান বিএনপির আইনজীবী ফোরামের সভাপতি জয়নুল আবেদীন।

এ ধারা প্রয়োগ করেই বেগম খালেদা জিয়াকে সাময়িক মুক্তি দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরদিন খালেদা জিয়ার সাজা নির্বাহী আদেশে স্থগিত করেন রাষ্ট্রপতি।

তবে তারেকের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন সোমবার বেনারকে বলেন, “আমাদের স্পষ্ট অবস্থান হলো তিনি মার্সি (ক্ষমা) চাইবেন না, আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি লাভ করবেন।”

এদিকে এই মুহূর্তে পুরো দেশ তারেক রহমানের ফেরার অপেক্ষায় উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বেনারকে বলেন, “কিন্তু তিনি কবে দেশে ফিরবেন, এটা সরকার জানে।”

তারেক রহমানের দেশে ফেরা প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ আসাদুজ্জামান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

465845720_975486687928070_7032585324774229178_n.jpg
‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শোভাযাত্রা শুরুর আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ৮ নভেম্বর ২০২৪। [সনি রামানী/বেনারনিউজ]

‘মাইনাস টু’ থেকে ‘মাইনাস ফোর’!

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আবারো নতুন করে আলোচনায় এসেছে এক-এগারোর সেনা সমর্থিত সরকারের বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ‘‌‌‌মাইনাস টু ফর্মুলা’।

সেনাবাহিনীর সমর্থনে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের দিনটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘এক এগারো’ হিসেবে পরিচিত।

ওই সময় দেশের বড়ো দুই দলের প্রধান শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে নতুন রাজনৈতিক ধারা চালু করার প্রক্রিয়াটি ‘‌‌‌মাইনাস টু ফর্মুলা’ হিসেবে পরিচিত। তখন দুই নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জেলে রাখা হয়। তারেক রহমান দেশ ছাড়েন ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এখনও সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে না দিয়ে বলছেন, তখনকার ‘মাইনাস টু’ এর লক্ষ ছিলেন দুই নেত্রী। আর এখনকার মাইনাস টু মানে দুই পরিবার; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবার।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পেছনে যেসব শক্তি সক্রিয় ছিল বা তাঁরা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা যেভাবে তৈরি করতে চান, তাতে অলিখিতভাবে দুই পরিবারকে রাজনীতির বাইরে রাখার বিষয়টি থাকতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এক-এগারো সরকার সম্পর্কে গবেষণামূলক একটি বই রয়েছে মহিউদ্দিন আহমদের।

“এখনও এক ধরনের মাইনাস ফোর দেখা যাচ্ছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তারেক ২০০৮ সাল থেকে বিদেশে। ৫ আগস্টের পর শেখ হাসিনা ভারতে। এরই মধ্যে লন্ডন যাচ্ছেন খালেদা জিয়া। তাঁর মানে দুই পরিবারের সবাই দেশের বাইরে। এগুলো বড়ো কোনো পরিকল্পনার অংশ কিনা, তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়নে ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল। সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, সেই মাইনাস টু ফর্মুলা নিয়ে কেউ যেন আবার চিন্তা না করে।

শরীফ নুরুল আম্বিয়া অবশ্য মনে করেন, আগের মাইনাস টু সফল হয়নি, আবার এমন আলোচনা হচ্ছে। তবে যে, যত কথাই বলুক সিদ্ধান্ত নেবে দেশের জনগণ। দ্রুত কিছু সংস্কার করে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করতে পারলে এসব আলোচনা পাত্তা পাবে না।

তারেকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি তিন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে বেনার। তাঁদের দুজন লন্ডনে থাকেন, একজন বাংলাদেশে। কেউই নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চাননি।

তাঁদের মতে, এখন তারেক দেশে ফিরলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নানামুখী চাপ বাড়বে। সেজন্য তারেকের পরিকল্পনা হচ্ছে, নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হলে দেশে ফেরা, এর মধ্যে সাজা হওয়া মামলাগুলো শেষ হয়ে যাবে বলেও তিনি আশাবাদী।

……………..

আপডেট: প্রতিবেদনে মাহদী আমিনের বক্তব্যের স্পষ্টিকরণ যোগ করা হলো।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।