ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সার্বজনীন কবরস্থানে আহমদীয়াদের লাশ দাফনে বাধা
2021.12.23
ঢাকা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের ঘাটুরা এলাকায় আহমদীয়া সম্প্রদায়ের দুই ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর স্থানীয়দের বাধার মুখে সার্বজনীন কবরস্থানে লাশ দাফন করতে পারেনি স্বজনেরা।
সংখ্যালঘু আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা বাংলাদেশে কাদিয়ানি নামেও পরিচিত।
ঘাটুরা গ্রামের আহমদীয়া মুসলিম জামাতের সদস্য বিলকিস হক (৫০) বুধবার রাতে ও এস এম ওসমান (৭০) বৃহস্পতিবার ভোরে মারা যান। সকালে গ্রামের কবরস্থানে তাঁদের মরদেহ দাফন করতে গেলে কয়েকজন বাধা দেন বলে কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
এ সময় স্থানীয় কয়েকজন মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে গ্রামবাসীকে আহমদিয়াদের প্রতিরোধের আহবান জানালে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে বলে বেনারকে জানান ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ এমরানুল ইসলাম।
তিনি বলেন, পরে গ্রামবাসীরা এসে কবরস্থানটি মুসলমানদের দাবি করে আহমদীয়া সম্প্রদায়কে লাশ দাফনে বাধা দেয়।
বাংলাদেশে আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রায় এক লাখের মতো মানুষ রয়েছেন। তবে সুন্নি এবং শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানেরা তাঁদেরকে মুসলমান হিসেবে স্বীকার করেন না।
“সকালে ঘটনা জানার পর আমরা দুই পক্ষের লোকদের নিয়ে ঘটনার সাময়িক সমাধান করেছি,” জানিয়ে ওসি এমরানুল বেনারকে বলেন, “দুইজনের মরদেহ কান্দিপাড়া এলাকায় আহমদীয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।”
ঘাটুরা গ্রামের আহমদীয়া মুসলিম জামাত বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক এসএম সেলিম বেনারকে বলেন, “আমাদের পূর্বপুরুষদের সবার দাফনই এই সরকারি কবরস্থানে হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এখানকার হেফাজতে ইসলামের আলেম ও তাদের অনুসারীরা আমাদেরকে এই কবরস্থানটি ব্যবহার করতে দিচ্ছে না।”
“ঘাটুরা এলাকায় প্রায় নব্বইটি আহমদীয়া পরিবারের পাঁচ শতাধিক মানুষের বসবাস। অথচ আমাদের স্বজনকে কবর দিতে হলো প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের একটি কবরস্থানে। এই আচরণ কোনোভাবেই মানবিক হতে পারে না,” বলেন সেলিম।
স্থানীয় চেয়ারম্যান বাধা দেবার অভিযোগ
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন আহমদীয়াদের অমুসলিম ও কাফির ঘোষণার দাবি করে আসছে দীর্ঘদিন থেকেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই বেশ কয়েকবার নানা কার্যক্রম পরিচালনার সময় এসব ইসলামী সংগঠনের বাধার মুখে পড়েছেন আহমদীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা।
এ প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুফতি মোবারক উল্লাহ বেনারকে বলেন, “স্থানীয় মুসলিমরা মনে করে একই স্থানে মুসলিম ও অমুসলিমের দাফন হলে কবরস্থানের পবিত্রতা নষ্ট হয় । তাই তারা সেটি করতে দেয় না।”
তবে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের নেতা এসএম সেলিম বেনারকে বলেন, “স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ তার কিছু লোক আমাদের সম্প্রদায়ের লোকদের এখানে দাফন করতে দিতে চায় না। স্থানীয় বেশিরভাগ মানুষেরই কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু তারা চেয়ারম্যানের ভয়ে কথা বলেন না। চেয়ারম্যান এই কবরস্থান ব্যবস্থাপনা কমিটিরও সভাপতি।”
সুহিলপুর ইউনিয়নের আওতাভুক্ত একটি গ্রাম ঘাটুরা। গত কয়েক বছর ধরেই আহমদীয়ারা ঘাটুরা কবরস্থানে দাফন করেন না বলে বেনারকে জানান সুহিলপুরের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আজাদ হাজারী আঙ্গুর।
তিনি বলেন, “আজকে দুইজনকে কবর দিতে গেলে স্থানীয়রা বাধা দেয়। পরবর্তীতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিষয়টির সুরাহা হয়।”
“স্থানীয় আলেম-ওলামারা মনে করেন আহমদীয়ারা মুসলমান নয়, তাই তাদের মসজিদ যেমন আলাদা, কবরস্থানও তেমনি আলাদা হওয়া প্রয়োজন,” জানিয়ে আজাদ হাজারী বলেন, “স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনগণ যা চায় তার পক্ষেই আমাকে থাকতে হয়।”
বৃহস্পতিবার লাশ দাফনের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান নিজেই বাধা দিয়েছেন সেলিমের এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই অভিযোগ মোটেও সত্য নয়।”
বারবারই বাধার মুখে আহমদীয়ারা
আহমদীয়া সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তিকে দাফন করতে বাধা দেয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগে গত বছরের ৯ জুলাই ঘাটুরা গ্রামের এই কবরস্থান থেকেই আহমদীয়া সম্প্রদায়ের এক শিশুর মরদেহ কবর থেকে তুলে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়।
২০১০ সালের এপ্রিল মাসে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় আহমদীয়া সম্প্রদায়ের একজন বয়স্ক ব্যক্তি মারা গেলে তাঁকে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করতে দেয়নি স্থানীয় মুসল্লিরা।
“আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর দেশজুড়ে জুলুম নির্যাতন চলছেই। শুধু দাফন কাজে বাধা নয়, উগ্র ইসলামপন্থীরা আমাদেরকে ধর্মচর্চাতেও নানাভাবে বাধা দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে,” বেনারকে বলেন আহমদীয়া মুসলিম জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা আহমদ তবশির চৌধুরী।
তিনি জানান, ১৯৮৭ সালের পর থেকে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই আহমদীয়া সম্প্রদায়ের চারটি মসজিদ দখল করে নিয়েছে উগ্র ইসলামপন্থীরা।
আলাদা কবরস্থান হবে
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘাটুরা এলাকায় ধর্মীয় বিরোধ থেকে যাতে কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তার জন্য আহমদীয়াদের আলাদা কবরস্থান নির্মাণ করার কথা বিবেচনা করছে স্থানীয় প্রশাসন।
আহমদীয়া সম্প্রদায়ের কবরস্থানে লাশ দাফনে বাধা দেয়াকে কেন্দ্র করে বারবার উত্তেজনা সৃষ্টি হয় জানিয়ে এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সাঈদ গণমাধ্যমকে জানান, “এবার সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আহমদীয়াদের জন্য আলাদা কবরস্থান নির্মাণ করে দেবে । এটি করে দেওয়া হলে আর কোনো সমস্যা হবে না।”
এ প্রসঙ্গে সদর থানার ওসি এমরানুল বেনারকে বলেন, “আগামী ১০ জানুয়ারি স্থানীয় প্রশাসন এবং দুইপক্ষের লোকদের নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য একটি আলাদা কবরস্থান করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
আলাদা কবরস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে আহমদীয়া নেতা তবশির চৌধুরী বলেন, “গত বছর একটি শিশুকে কবর থেকে তুলে রাস্তার পাশে ফেলা দেয়ার পর পরই এই বিষয়টি আলোচনা হয়েছে কিন্তু তার কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখন দেখা যাক কী হয়।”
“স্থানীয় আহমদীয়া জামাত পরিবারগুলোর বাপ-দাদাদের দাফন ঘাটুরার ওই কবরস্থানেই হয়েছে। এখন তাদের পরের প্রজন্মের অন্যত্র দাফন হবে- এটা দুঃখজনক,” যোগ করেন তবশির চৌধুরী।