চিলাহাটিকে মংলার সাথে সরাসরি যুক্ত করতে রেলের প্রকল্প
2022.04.20
ঢাকা

ভারতের সাথে রেলওয়ে সংযোগ স্থাপনসহ উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরির জন্য ২০২০ সালে চালু চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথের অবকাঠামো বৃদ্ধি করতে একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, নেপাল ও ভুটান বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মংলার সাথে সরাসরি যুক্ত হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
‘ভারতের সাথে রেল সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে চিলাহাটি এবং চিলাহাটি বর্ডারের মধ্যে ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ’ নামক এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৪১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বাস্তবায়িত হবে এই প্রকল্প।
ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা নীলফামারীর ডোমার উপজেলার চিলাহাটি স্টেশনের সাথে মংলা বন্দরের সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন করা হলে বাংলাদেশের দারিদ্রপীড়িত বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে, সেখানকার দারিদ্র কমবে।
চিলাহাটি রেলপথটি ভারতের হলদিবাড়ি রেলপথের সাথে সরাসরি যুক্ত যার মাধ্যমে বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটানের সাথে সংযুক্ত হবে।
বাংলাদেশে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কামরুল আহসান বুধবার বেনারকে বলেন, “২০২০ সালের ডিসেম্বরে আমরা চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথটি ৫৫ বছর পর চালু করেছি। এই রেলপথ দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত মিতালী এক্সপ্রেস চালু করতে যাচ্ছি। ট্রেনটি ঢাকা থেকে নিউ জলপাইগুড়ি চলাচল করবে।”
তিনি বলেন, “কিন্তু এই রুট দিয়ে বড়ো পরিসরে মালবাহী ট্রেন পরিচালনার জন্য কিছু অবকাঠামোগত ঘাটতি রয়েছে। সেই ঘাটতি পূরণ করতে ২০১৮ সালে প্রণীত প্রকল্পের সংশোধনী মঙ্গলবার একনেক সভায় অনুমোদিত হয়েছে।”
“এই রুটটি উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই স্টেশন দিয়ে ভারতের দার্জিলিংসহ পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম, নেপাল ও ভুটান যাওয়া খুব সহজ হবে,” বলেন কামরুল আহসান।
উত্তরাঞ্চল বিনিয়োগের জন্য ভালো স্থান
বাংলাদেশ রেলওয়ের বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যিক রেলপথ বিষয়ক অধিশাখার সাবেক উপপরিচালক কালিকান্ত ঘোষ বেনারকে জানান, চিলাহাটি থেকে বর্তমানে সরাসরি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে যাওয়া যায়। সেখান থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার ভারতীয় ভূখণ্ড পাড়ি দিলেই নেপালের পানিরট্যাংকি পয়েন্টে যাওয়া যাবে। একইভাবে আরেকদিকে সমপরিমাণ ভারতীয় ভূখণ্ড অতিক্রম করলে ভারত-ভুটান সীমান্তে যাওয়া যাবে।
ভারত ও বাংলাদেশ চাইলে নেপাল ও ভুটান থেকে পণ্য স্বল্প খরচে চিলাহাটি হয়ে রেলপথে বাংলাদেশে আনা সম্ভব।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পরও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথটি চালু ছিল। কিন্তু ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পর এই রেলপথটি পরিত্যক্ত হয়।
বাংলাদেশ ও ভারত সরকার ২০১৫ সালে রেলপথটি আবার চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে রেলপথটি স্বল্প পরিসরে উদ্বোধন করেন। তবে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগের জন্য এই রেলপথে অবকাঠামোগত ঘাটতি থেকে যায়। এই ঘাটতি দূর করতেই নতুন সংশোধিত প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, “আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চল বিনিয়োগের জন্য ভালো স্থান বলা যায়, যদিও বর্তমানে সেখানে বিনিয়োগের আদর্শ অবস্থা নেই। তবে ভবিষ্যতে ভারত, নেপাল, ভুটান এমনকি চীনেও বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।”
তিনি বলেন, “মংলা বন্দরের সাথে সরাসরি রেল সংযোগ একটি ভালো উদ্যোগ; বিনিয়োগের জন্য একটি ভালো শর্ত।”
বর্তমানে চিলাহাটি রেলস্টেশনটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বিভাগীয় শহর খুলনার সাথে সরাসরি যুক্ত। মংলা বন্দরের সাথে খুলনার সরাসরি রেল যোগাযোগ নেই।
মংলা বন্দরকে খুলনা হয়ে দেশের মূল রেলপথের সাথে সংযুক্ত করতে ২০১৩ সাল থেকে ভারতীয় অর্থায়নে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করছে সরকার।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস.এম. সল্লিমুল্লাহ বাহার বুধবার বেনারকে বলেন, “খুলনা-মংলা রেল সংযোগ প্রকল্প সঠিকভাবে এগুচ্ছে। আশা করা যায় এবছর ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যাবে।”
এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে “মংলা বন্দর সারাদেশের রেল যোগাযোগের আওতায় আসবে,” বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে “অনেক আগেই বিনিয়োগ হতে পারত। কিন্তু অবকাঠামোর অভাবে বিনিয়োগ হয়নি,” বলে বুধবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি জসিম উদ্দিন।
তাঁর মতে, দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পর সেখানে এখন বিনিয়োগ হচ্ছে। মংলা বন্দরের সাথে সরাসরি রেল সংযোগ স্থাপন ওই অঞ্চলে বিনিয়োগে ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, “সরকার ভুটান ও নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির চেষ্টা করছে। সেটা যদি সম্ভব হয় সেক্ষেত্রে উত্তরাঞ্চলে খুব সস্তায় বিদ্যুৎ আমদানি করা সম্ভব। সস্তা বিদ্যুৎ ও সমুদ্রবন্দরের সাথে সরাসরি রেল যোগাযোগের কারণে বিনিয়োগের জন্য ওই এলাকা ভবিষ্যতে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।”
তবে “উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বিনিয়োগ,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিনিয়োগের জন্য ভারত, নেপাল ও ভুটানের সহযোগিতা দরকার। অন্যথায় বিনিয়োগ হবে না।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “অনেক সময় দেখা যায় বিনিয়োগের জন্য আমরা ভালো অবকাঠামো নির্মাণ করলাম। কিন্তু ভারতীয় অংশে কিছু নেই। যেমন বাংলাদেশের বেনাপোলে খুব ভালো অবকাঠামো রয়েছে। কিন্তু সীমান্তের ওপার পেট্রাপোলে তেমন কিছুই নেই।”
“উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান সকলের সহযোগিতার প্রয়োজন,” বলেন জসিম উদ্দিন।