মার্কিন প্রতিবেদন: সরকারি অর্থ ব্যয়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারছে না সংসদ
2023.06.28
ঢাকা
সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে জবাবদিহি করতে পারছে না বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সংসদীয় কমিটিগুলো।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি রয়েছে। প্রতি মাসে অন্তত একটি বৈঠক করে এর অধীনস্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিভাগকে জবাবদিহি করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ বৈঠকে কেবল সরকারি বিল পাসের সুপারিশ করা হয়।
মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত আর্থিক স্বচ্ছতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে যেসব দেশ আর্থিক স্বচ্ছতার ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করেনি, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশ এই সময়ে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড়ো কোনো অগ্রগতিও অর্জন করেনি।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আর্থিক স্বচ্ছতার বিষয়ে আলোকপাত করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাজেট প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে প্রণয়ন করা উচিত।
আন্তর্জাতিক মান অনুসারে, প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের খরচ আলাদাভাবে প্রকাশ করা উচিত, যা সঠিকভাবে করা হয় না। একইসঙ্গে দেশের নিরীক্ষা বিভাগের নিরীক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে হবে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
রোববার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অর্থ বিল পাস এবং সোমবার প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ সম্বলিত নির্দিষ্টকরণ বিল পাস হয়েছে।
এর দু’দিন পরেই বাংলাদেশের বাজেট প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার বিষয়ে আলোকপাত করে মার্কিন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো।
বাংলাদেশের বাজেট প্রক্রিয়া ‘কিছুটা জটিল’
২০২৩-২৪ অর্থবছরের অর্থ বিল অনুযায়ী, ২০২৩ সালের পহেলা জুলাই থেকে ৩০ জুন ২০২৪ সময়ের মধ্যে সরকার কোন খাত থেকে কত টাকা কর ও ভ্যাট আদায় করবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলা রয়েছে। নির্দিষ্টকরণ বিলে কোন মন্ত্রণালয় আগামী এক বছরের জন্য কত টাকা বরাদ্দ পেয়েছে তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে।
তবে সরকারের কোন বিভাগ কত টাকা কোন কোন খাতে খরচ করেছে এমন তথ্য প্রকাশ করা হয় না বলে বেনারকে জানিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, “মার্কিন ফিসক্যাল ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্টে বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়ন সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, সেটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক।
“আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি বিভাগের খরচের ব্যাপারে ‘পাবলিক ডিসক্লোজার’ দেওয়া উচিত কিন্তু বাংলাদেশে সেটি করা হয় না বললেই চলে,” বলেন গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি জানান, সরকারের আর্থিক নিয়মগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে কি না সে ব্যাপার তদারকির জন্য নিরীক্ষা বিভাগ রয়েছে। নিরীক্ষা বিভাগ প্রতিবেদন প্রস্তুত করে রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেয় এবং রাষ্ট্রপতি সেগুলো সংসদে উপস্থাপনের ব্যবস্থা করেন। উত্থাপিত প্রতিবেদনগুলো সংসদের সরকারি হিসাব কমিটিতে আলোচনা হয় এবং নিষ্পত্তি হয়।
“সরকারি হিসাব কমিটির দু’একটি কমিটির প্রতিবেদন ছাড়া আর কিছু জানানো হয় না। প্রতিটি প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে দেওয়া উচিত, যার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়। তাছাড়া, আমাদের দেশের নিরীক্ষার মানও উন্নত করতে হবে,” বলেন গোলাম মোয়াজ্জেম।
সরকারি হিসাব কমিটির সদস্য এবং অনুমিত হিসাব কমিটির সভাপতি আব্দুস শহীদ বুধবার বেনারকে বলেন, “আমাদের বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল। অনেক সংসদ সদস্যই বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝতে পারেন না, যদিও বাজেট প্রণয়নে তাঁদের কাজ সহজ করতে বাজেট অ্যানালাইসিস অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিট (বামু) রয়েছে।”
তিনি জানান, সরকারি অর্থ ব্যয়ের ওপর সংসদের খবরদারি নিশ্চিত করতে চারটি কমিটির বিধান রয়েছে; অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, সরকারি হিসাব কমিটি, অনুমিত হিসাব কমিটি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি।”
আব্দুস শহীদ বলেন, “দুঃখের বিষয় হলো, অধিকাংশ কমিটি আর্থিক বিষয়ে সরকারকে জবাবদিহি করতে পারছে না।”
উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, “সরকারি হিসাব কমিটিতে হাজার হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম সংক্রান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপিত হয়। সেগুলো এই কমিটিতে আলোচনার মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সেগুলো নিষ্পত্তি করার কথা। দেখা যায়, বিষয়গুলো আলোচনা হয়, তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও ছয় মাস পার হয়ে যায়—প্রতিবেদন পাওয়া যায় না। এক সময় আমরা বাধ্য হয়ে নিষ্পত্তি করে দেই। ফলে যাঁরা দোষী তারা মাফ পেয়ে যান।”
সহজ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে
যদিও সরকার বলছে, সরকারি অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়গুলো সহজ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী ও সাবেক অর্থ প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান বুধবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ—সে কথা বলা যাবে না। প্রতি বছর সরকার কত টাকা আয় করবে এবং কত টাকা ব্যয় করবে সেগুলো মন্ত্রণালয় মোতাবেক অনুমোদন নেওয়া হয়। সংসদের অনুমোদন ছাড়া কোনো অর্থ ছাড় হয় না।”
তিনি আরও বলেন, “এখানে কত টাকা আয় হয় এবং কত টাকা ব্যয় হয় সবই সংসদকে জানানো হয়। সুতরাং, এখানে অস্বচ্ছতার কোনো ব্যাপার নেই।”
আব্দুল মান্নান বলেন, “তবে বিষয়টি অনেকের কাছেই জটিল মনে হতে পারে। বিষয়টি সহজতর করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এগুলো সহজবোধ্য করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।”
মার্কিন এ প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য বিশ্বের ১৪১টি দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, যারা যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বিদেশি সহায়তা পাওয়ার যোগ্য। তাতে দেখা গেছে, ৭২টি দেশ আর্থিক স্বচ্ছতা পূরণে ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করেছে। তবে ৬৯টি দেশ এই মানদণ্ড পূরণ করেনি, যেগুলোর তালিকায় আছে বাংলাদেশের নাম।