ডিজেলের দাম বৃদ্ধি: পরিবহন ধর্মঘটে জনজীবন প্রায় স্থবির
2021.11.05
ঢাকা
ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়ানোর প্রতিবাদে শুক্রবার শুরু হওয়া সর্বাত্মক পরিবহন ধর্মঘটে ঢাকাসহ সারাদেশের জনজীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো সত্ত্বেও শুক্রবার রাত দশটা পর্যন্ত ধর্মঘট প্রত্যাহার করেননি পরিবহন মালিকেরা।
শুক্রবার ঢাকা থেকে দেশের অন্য কোথাও বাস-ট্রাক চলাচল করেনি। আন্তঃজেলায়ও যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল।
জ্বালানী তেল ডিজেলের দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই ধর্মঘটে সমর্থন দিয়েছে প্রধান বিরোধীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শুক্রবার এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে জনগণের অসুবিধা ও দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে যানবাহন চলাচলের আহ্বান জানালেও তা শোনেননি পরিবহন খাতের নেতারা।
সারা বিশ্বে সব ধরনের জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটার ৬৫ টাকা থেকে ৮০ টাকা করেছে জ্বালানী আমদানিকারক দেশ বাংলাদেশ।
তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, ডিজেলের এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে সকল ধরনের পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়বে দরিদ্র ও নিম্নবিত্তর মানুষ।
মুখের কথায় কীভাবে গাড়ি চালাব?
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লা শুক্রবার বেনারকে জানান, “সরকার ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে আমাদের আহ্বান জানাচ্ছেন, বলছেন ভাড়া বৃদ্ধি করা হবে। সেটি ঠিক আছে। কিন্তু মুখের কথায় আমরা কীভাবে গাড়ি চালাব।”
“সরকার তো ভাড়া বৃদ্ধি সংক্রান্ত কোনো গেজেট প্রকাশ করেনি। এ অবস্থায় গাড়ির মালিকদের কীভাবে গাড়ি চালাতে বলব?,” প্রশ্ন রাখেন তিনি।
“আমরা হিসাব করে দেখেছি, ডিজেলের সাম্প্রতিক দাম বৃদ্ধির কারণে গড়ে প্রতিটি যাত্রীবাহী গাড়ির দৈনিক খরচ কমপক্ষে আড়াই হাজার টাকা বৃদ্ধি পাবে। এই টাকা আমরা কোথা থেকে দেবো? অনেক মালিকের দৈনিক আয় আড়াই হাজার টাকা হয় না,” বলেন খন্দকার এনায়েত।
সরেজমিন দেখা যায়, শুক্রবার রাজধানী ঢাকায় সিটি সার্ভিসসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। মহাখালী, গাবতলি ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে কোনো গাড়ি ছাড়েনি।
যা বলছে সরকার
বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মীর আসলাম উদ্দিন শুক্রবার বেনারকে বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানীর দাম বৃদ্ধির কারণে সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশে সর্বাধিক ব্যবহৃত ডিজেলের দাম বৃদ্ধি না করায় বেশি দামে আমদানি করে প্রতি লিটার ডিজেলে ১৩ টাকার বেশি (অক্টোবর মাসে) লোকসান দিয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন।
২০১৩ সালের পর এই প্রথমবারের মতো ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে জানিয়ে মীর আসলাম বলেন, ২০১৬ সালে ডিজেলের দাম ৬৮ টাকা থেকে কমিয়ে ৬৫ করা হয়।
তিনি বলেন, ভারতে কলকাতায় প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য বাংলাদেশি টাকায় ১২৪ দশমিক ৩৭ টাকা।
ডিজেলের চেয়ে কেরোসিনের দাম কম থাকলে ডিজেলের মধ্যে কেরোসিন মিশিয়ে ভেজাল দেয় অসাধু ব্যক্তিরা। সে কারণে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম একই স্তরে রাখা হয় বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানীর দাম কমলে বাংলাদেশেও ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমাবে সরকার।
রোববার বাড়ছে ভাড়া
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস শুক্রবার রাতে বেনারকে বলেন, “সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সরকার যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে কতটুকু বৃদ্ধি পাবে সে ব্যাপারে আমরা এখনও কোনো প্রস্তাব প্রস্তুত করতে পারিনি।”
তিনি বলেন, আগামী রোববার ভাড়া বৃদ্ধির ব্যাপারে এক সভা অনুষ্ঠিত হবে; সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে ভাড়া কতটুকু বৃদ্ধি করা হবে।
‘প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়বে’
ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে শুক্রবার বেনারকে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করলে বাস ভাড়া, ট্রাক ভাড়া বৃদ্ধি পাবে। ফলে কৃষি পণ্য থেকে শুরু করে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়বে।”
তবে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি না করে “সরকারের কোনো উপায় নেই” জানিয়ে তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেখানে প্রতি লিটার ডিজেলে দাম বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি।”
“বাংলাদেশে ডিজেলের দাম ভারতের চেয়ে কম হলে আমাদের দেশ থেকে ডিজেল ভারতে পাচার হয়ে যাবে। সেটি আমাদের অর্থনীতির জন্য খারাপ হবে,” বলেন অধ্যাপক মইনুল।
তাঁর মতে, “এক দফায় প্রতি লিটার ১৫ টাকা বা শতকরা ২৩ ভাগ বৃদ্ধি না করে দফায় দফায় দাম বৃদ্ধি করা হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ত না।”
“তবে, কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি না করাই ভালো হতো। কারণ কেরোসিন নিম্নবিত্ত মানুষ ব্যবহার করে,” বলেন তিনি।
ভাড়া বৃদ্ধির আগেই মূল্য বৃদ্ধি
সরকার ভাড়া বৃদ্ধির আগেই রাজধানীর খুচরা বাজারের বিভিন্ন পণ্যের মূল্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
রাজধানীর নিম্নবিত্তের মানুষ অধ্যুষিত মিরপুরের দুয়ারিপাড়া এলাকায় মুরগির খুচরা ব্যবসা করেন মো. আরিফ। তিনি জানান, ডিজেলের দাম বৃদ্ধি ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়িয়ে দেবে।
তিনি বেনারকে বলেন, “রাজশাহী থেকে ঢাকায় মুরগিবাহী একটি বড়ো ট্রাকের ভাড়া বর্তমানে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে সেই ভাড়া কমপক্ষে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা হবে বলে অনুমান করা যায়।”
তিনি বলেন, “এই বাড়তি ভাড়ার চাপ মুরগির খুচরা দামের ওপর প্রভাব ফেলবে।”
“বর্তমানে গড়ে এক কেজি ব্রয়লার মুরগি কিনতে আমাদের খরচ পড়ে ১৫০ টাকা। আমরা খুচরা বাজারে বিক্রি করি ১৭০ টাকায়। ট্রাকের ভাড়া বৃদ্ধি পেলে এক কেজি ব্রয়লার আমাদের কমপক্ষে ১৮০ টাকা বিক্রি করতে হবে,” বলেন আরিফ।
“বগুড়া থেকে ১৩ টন চাল নিয়ে ঢাকায় আসতে ভাড়া দিতে হয় ১২ হাজার টাকা। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে সেই ভাড়া কমপক্ষে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা হতে পারে,” বেনারকে জানান মিরপুর-১২ নম্বর এলাকায় চালের আড়তদার মো. মতিউর রহমান।
“আমাদের হিসাবে ট্রাক ভাড়া ও শ্রমিকদের মজুরিতে প্রতি কেজি এক টাকা ২০ পয়সা প্রয়োজন হয়। সেই হিসাবে কেজিতে এখন চালের দাম দুই টাকা বাড়তে পারে,” বলেন মতিউর।