বিদেশি টিভি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারবে না

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.09.30
ঢাকা
বিদেশি টিভি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারবে না ভারতের জি বাংলা চ্যানেলে একটি ধারাবাহিক নাটক দেখছেন ঢাকার একজন দর্শক। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

বিদেশি কোনো টেলিভিশন চ্যানেল যেন বিজ্ঞাপনসহ কোনো অনুষ্ঠান বাংলাদেশে প্রচার করতে না পারে সেই লক্ষ্যে বিদেশি চ্যানেলের পরিবেশক ও কেবল অপারেটরদের বিরুদ্ধে শুক্রবার থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার ঘোষণা দিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। 

বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে মন্ত্রী বেনারকে জানান, কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন-২০০৬ অনুযায়ী কোনো বিদেশি চ্যানেল বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনসহ সম্প্রচার করতে পারে না।

তবে বিদেশি মূলত ভারতীয় চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে বছরের পর বছর ধরে বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছে।

বিদেশি চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপন ছাড়া অনুষ্ঠানমালাকে কারিগরি ভাষায় ‘ক্লিনফিড’ বলা হয়। 

মন্ত্রী আরও বলেন, যদি কোনো কেবল অপারেটর টেলিভিশনের সিরিয়াল পরিবর্তন করে, অথবা নিজেরা বিজ্ঞাপন অথবা অনুষ্ঠান প্রচার করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সরকারের এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আর্থিকভাবে উপকৃত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

গত কয়েক বছর ধরে আলোচনা চললেও এই প্রথমবারের মতো বিদেশি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন প্রচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। 

“আমি বিদেশি চ্যানেলগুলোর পরিবেশক, কেবল অপারেটর, বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মালিকদের সাথে সভা করে বলেছি কোনো বিদেশি টেলিভিশন বাংলাদেশে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারবে না। অর্থাৎ তাদের ‘ক্লিনফিড’ প্রচার করতে হবে,” বলেন হাছান মাহমুদ। 

তিনি বলেন, “শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে বিদেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে না। নেপালেও বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আছে। বাংলাদেশেও বিদেশি চ্যানেলগুলোকে ক্লিনফিড প্রচার করতে হবে।” 

মন্ত্রী বলেন, “আমাদের এই সিদ্ধান্ত দেশের স্বার্থে, দেশীয় টেলিভিশনগুলোর স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে। আমি ভারতীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রীকেও জানিয়েছি যে, পহেলা অক্টোবর থেকে ভারতীয় চ্যানেলগুলোকে ক্লিনফিড প্রচার করতে হবে।” 

“বিদেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন প্রচার করার কারণে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১২‘শ কোটি টাকা হারাচ্ছে,” বলেন মন্ত্রী। 

সিদ্ধান্তকে স্বাগত

গত ২ সেপ্টেম্বর কেবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব), কেবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ঐক্য পরিষদ), কেবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সমন্বয় পরিষদ), অ্যাসোসিয়েশন অব টিভি চ্যানেল ওনার্স, পরিবেশক নেশনওয়াইড মিডিয়া লিমিটেড, যাদু ভিশন লিমিটেড ও ওয়ান অ্যালায়েন্স লিমিটেডের প্রতিনিধিদের সাথে সভা করেন মন্ত্রী।

ওই সভার সিদ্ধান্ত হয়, ৩০ সেপ্টেম্বরের পর ক্লিনফিড ছাড়া কোনো বিদেশি চ্যানেল অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে পারবে না। সভার সিদ্ধান্তের একটি কপি বেনারের কাছে রয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিকালে নেশানওয়াইড মিডিয়া লিমিটেডের একজন প্রতিনিধি সচিবালয়ে তথ্যমন্ত্রীকে জানান, তাঁরা শুক্রবার থেকে ‘ক্লিনফিড’ প্রচার করবেন। তবে নেশানওয়াইড মিডিয়া লিমিটেডের ওই কর্মকর্তা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেননি। তিনি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে ওই প্রতিষ্ঠানের একটি চিঠি হস্তান্তর করেন।

চিঠিতে বলা হয়, আগামীকাল থেকে তাঁরা বিদেশে নির্মিত বিজ্ঞাপন ছাড়াই বাংলাদেশে ক্লিনফিড প্রচার করবে। 

বিদেশি চ্যানেলগুলোর ক্লিনফিড প্রচারের সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আজ স্থায়ী কমিটির সভায় তথ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, ১ অক্টোবর থেকে যেসব বিদেশি চ্যানেল বিজ্ঞাপন প্রচার করবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা সরকারকে এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ সমর্থন জানিয়েছি।” 

কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইনের ১৯ (১৩) নম্বর ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশি দর্শকদের জন্য বিদেশি চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করা নিষিদ্ধ থাকলেও বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে ভারতে নির্মিত বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছে।

ওই আইন অনুযায়ী, বিদেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন প্রচার করলে কমপক্ষে দুই বছর সাজা এবং সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

বড়ো বড়ো বিজ্ঞাপনদাতারা বাংলাদেশের পরিবর্তে ভারতে নির্মিত বিজ্ঞাপনগুলো ভারতীয় চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রচার করে থাকে। ফলে বাংলাদেশি বিজ্ঞাপন নির্মাতারা বড়ো কাজ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলোও বিজ্ঞাপন হারাচ্ছে।

বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো ফ্রি-টু-এয়ার হওয়ায় বিজ্ঞাপন ছাড়া তাদের কোনো আয়ের উৎস নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন ভারতীয় চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রচার হওয়ার কারণে বিজ্ঞাপনদাতারা লাভবান হচ্ছেন। 

বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোর সহসভাপতি ও একাত্তর টিভির প্রধান মোজাম্মেল বাবু বেনারকে বলেন, “সরকারের এই সিদ্ধান্তে আমরা আনন্দিত। এটি আমাদের অনেক দিনের দাবি। এর মাধ্যমে আমরা উপকৃত হবো, দেশ উপকৃত হবে।” 

তিনি বলেন, “বিজ্ঞাপনদাতারা আমাদের বলতেন, তাঁরা ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপন দেন। তাই, বাংলাদেশের কোনো চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেয়ার প্রয়োজন নেই।” 

মোজাম্মেল বাবু বলেন, “এই অবস্থার ফলে বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনের আয় কমে গেছে। সেখানে চাকুরিচ্যুতি ঘটছে। কারণ একটি প্রথম সারির নিউজ চ্যানেল পরিচালনা করতে মাসে কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়।”

বাংলাদেশে বর্তমানে ৪০টি বেসরকারি চ্যানেল চালু রয়েছে, আরও কয়েকটি পাইপলাইনে রয়েছে বলে তিনি জানান।

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল স্পাইস টিভি’র পরিচালক (অপারেশন) মোহাম্মদ আক্তার হোসেন বেনারকে বলেন, “বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে প্রচারের জন্য পরিবেশকদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা আদায় করে। আর পরিবেশকরা কেবল অপারেটরদের কাছ থেকে এবং কেবল অপারেটররা গ্রাহকের কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে টাকা নেয়। সুতরাং, বিদেশি চ্যানেলগুলো এ দেশে বিজ্ঞাপন প্রচার করে যে টাকা নিচ্ছে, সেটি অযৌক্তিক।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।