ইউক্রেন-রাশিয়া: জাতিসংঘে ভোট না দেওয়ায় বাংলাদেশে বিরোধীদের সমালোচনার মুখে সরকার

আহম্মদ ফয়েজ
2022.03.07
ঢাকা
ইউক্রেন-রাশিয়া: জাতিসংঘে ভোট না দেওয়ায় বাংলাদেশে বিরোধীদের সমালোচনার মুখে সরকার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের নিকটবর্তী ইরপিন শহরের কাছে নিজের শিশু সন্তানসহ রাশিয়ার হামলায় বিধ্বস্ত একটি সেতু পার হচ্ছেন এক নারী। ৭ মার্চ ২০২২।
[এএফপি]

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ওঠা প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বাংলাদেশ বিরত থাকার ঘটনা দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ ঘটনায় সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ করেছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, কেউ কেউ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কথা বলছে।

গত বুধবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়। এ প্রস্তাবে বাংলাদেশসহ ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। এর কারণ হিসেবে সরকার বলছে ভোট না দেয়ার কারণ ছিল ‘কৌশলগত’।

“বাংলাদেশের এই অবস্থান জাতি হিসেবে আমাদের ছোট করেছে। ভোট প্রদানে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের প্রতিফলন হয়নি,” সোমবার এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

বিএনপি এ প্রসঙ্গে ইতোমধ্যে প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেছে জানিয়ে ফখরুল বলেন, “ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত রাখতে দেশবাসীর জনমতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। আমরা ইউক্রেনের ওপর এই আক্রমণকে নিন্দা করছি। আমরা মনে করি, এ ধরনের আক্রমণ একটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।”

সরকারের এই অবস্থানের ফলে দেশ নতজানু পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে বলে দৃশ্যমান হয় দাবি করে তিনি বলেন, “এ ধরনের আধিপত্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী তৎপরতা জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী অপরাধ।”

দেশবাসীর জনমতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকায় সরকার বাংলাদেশের সংবিধান ঘোষিত গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধের নীতিমালা পরিপন্থী কাজ করেছে বলে অভিমত ফখরুলের।

ভিন্ন ভিন্ন মত বামদলগুলোর

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ওঠা প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বাংলাদেশের বিরত থাকা প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন মত দিচ্ছে সরকারের জোটে থাকা ও জোটের বাহিরে থাকা বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো।

সরকারের নেয়া অবস্থানকে যথাযথ মনে করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।

“আমি মনে করি বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে যে অবস্থান নিয়েছে তা খুবই যুক্তিযুক্ত। অমাদের কোনোক্রমেই উচিত নয় এই পরিস্থিতিতে কোনো পক্ষভুক্ত হওয়া,” বেনারকে বলেন সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মেনন।

অপরদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক সময় রুশপন্থী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি শাহ আলম বেনারকে বলেন, “জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকা কতটুকু ঠিক হয়েছে বা হয়নি, তা নিয়ে মন্তব্য করা কঠিন। তবে এটুকু বলা যায় বাংলাদেশের অবস্থান অবশ্যই যুদ্ধের পক্ষে হওয়া উচিত হবে না এবং সরাসরি কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয়া ঠিক হবে না।”

সরকারি জোটের বাহিরে থাকা দেশের শীর্ষস্থানী নয়টি বামপন্থীদলে একটি জোটে বর্তমানে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।

তিনি বেনারকে বলেন, “জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত থেকে বাংলাদেশ সরকার দেশের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সরকারের উচিত ছিল এই প্রস্তাবে ভোট দেয়া এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নেয়া।”

এই বাম নেতা আরো বলেন, “বাংলাদেশের যেমন রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া উচিত তেমনি পশ্চিমাদের বলয় থেকেও দূরে থাকা উচিত।”

কথা বলতে বৈঠক দরকার জাপার

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর জোটের শরিক ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) শীর্ষ নেতৃত্ব বিষয়টি ‘স্পর্শকাতর’ আখ্যা দিয়ে বলছেন এই বিষয়টিতে কোনো মতামত প্রদানের জন্য পার্টির নিজস্ব ফোরামে বৈঠক প্রয়োজন।

মন্তব্য জানতে চেয়ে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের রোববার রাতে বেনারকে বলেন, “বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। দলীয় ফোরামে আলোচনা না করে এ বিষয়ে ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে আমার মন্তব্য করা উচিত হবে না।”

অপরদিকে বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও।

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ইসলামী দলগুলো

ইউক্রেন-রাশিয়ার পরিস্থিতি বা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের ভোটদান থেকে বিরত থাকা প্রসঙ্গে এখনো কোনো পরিষ্কার অবস্থান জানাচ্ছে না দেশের ইসলামী দলগুলো।

এ প্রসঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের দলীয় অবস্থান কী? এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা শহিদুল ইসলাম কবির বেনারকে বলেন, “আমরা এখনো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। এখনো এ বিষয়ে আমাদের দলের কোনো বক্তব্য নেই।”

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক মীর মোহাম্মদ ইদ্রিস বেনারকে বলেন, “আমরা বোঝার চেষ্টা করছি এই যুদ্ধ পরিস্থিতির ফলে ইসলামের ওপর কোনো আঘাত আসে কিনা। যদি এমন কিছু হয় তবে আমরা প্রতিক্রিয়া জানাব।”

সরকার বলছে কৌশলগত কারণের কথা

বাংলাদেশ সরকার কী কারণে জাতিসংঘে ভোটদানে বিরত ছিল সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শনিবার চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘে ভোটদানে বিরত ছিল।

এই কৌশলগত কারণ কী, সেটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে সবার সাথে বন্ধুত্ব এবং আমরা অবশ্যই যেকোনো সংঘাতের বিরোধী। পৃথিবীতে শান্তি স্থাপিত হোক, শান্তি বিরাজ করুক, সেটিই আমরা চাই। এই কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘে ভোটদানে বিরত ছিল।”

একই দিন ঢাকায় আলাদা একটি অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশ শান্তি চায় এবং যুদ্ধের বিপক্ষে বলেই ভোট দানে বিরত ছিল।

“আমরা শান্তি চাই, সেজন্য আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমরা। যুদ্ধের সপক্ষে আমরা ভোট দেইনি,” বলেন মোমেন।

তিনি আরও বলেন, “আমরা জাতিসংঘেও একই কথা বলেছি। আমরা বলেছি, আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। শান্তির মাধ্যমে আলোচনার মাধ্যমে যাতে সমাধান হয়।”

এর আগে গত ২ মার্চের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) সভার আলোচনার বরাত দিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুদ্ধবিরোধী নিরপেক্ষ অবস্থান এর পর দিন বেনারের কাছে ব্যাখ্যা করেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য রাশিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতার থাকার কথা উল্লেখ করে সরকারের অন্যতম এই মুখপাত্র বলেন, “সার্বিকভাবে আমরা যুদ্ধের বিরোধী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) পরিষ্কার বলেছেন, আমরা শান্তিকামী দেশ, শান্তি চাই।”

“ইউক্রেন আমাদের বন্ধু, আর রাশিয়া-তো দীর্ঘদিনের গভীর বন্ধু,” বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

এই সংঘাতে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ না নিয়ে “কৌশলগত জায়গা থেকে কিছুটা নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করবে,” করবে বলে মনে করেন ভূরাজনীতি ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন।

“বাংলাদেশের মতো আরো অনেক দেশই চলমান সংঘাতে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করবে,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।