বাংলাদেশের সাথে রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে চায় যুক্তরাষ্ট্র
2023.02.15
ঢাকা
দৃশ্যমান টানাপোড়েনকে পেছনে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করা হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ সফরকারী পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে।
বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোমেনের সাথে বৈঠকের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের সাথে রাজনৈতিক, নিরাপত্তা সম্পর্কিত এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের আরও উন্নয়ন করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
দুই দেশই রোহিঙ্গা সংকটের কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ প্রসঙ্গে ডেরেক শোলে বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণ বের করে তা সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে সাহায্য করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি দৃশ্যমান হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন, যে নির্বাচন এ বছরের শেষে অথবা ২০২৪ সালের প্রথম সপ্তাহে হওয়ার কথা রয়েছে।
ওই নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করাসহ বিভিন্ন দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো আন্দোলন শুরু করেছে।
সম্পর্ক বাড়াতে চায় যুক্তরাষ্ট্র
বুধবার সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ডেরেক শোলে।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বৈঠকগুলোতে কাউন্সেলর শোলে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকারের সুরক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে সহযোগিতা ও একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক গড়ে তোলার উপর জোর দেন।
বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় বলেছেন, “আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে।”
সাক্ষাতের পর প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
তবে শোলের সঙ্গে ক্লোজড ডোর মিটিংয়ের পর সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন নেননি প্রধানমন্ত্রীর কর্মকর্তা। ডেরেক শোলেও সাংবাদিকদের প্রশ্ন নেননি।
নজরুল ইসলাম জানান, প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বলেন, আগামী সাধারণ নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে তাঁর দল দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তিনি বলেন, “আমি কখনোই ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চাই না।”
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোমেনের সাথে বৈঠক করেন ডেরেক শোলে।
সভা শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দাঁড়িয়ে ডেরেক শোলে সাংবাদিকদের সফর সম্পর্কে কিছু বক্তব্য তুলে ধরলেও সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্ন নেননি।
“বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়ার কারণেই আমরা আজকে এখানে এসেছি,” জানিয়ে শোলে বলেন, “আমরা এই সম্পর্ক রাজনৈতিকভাবে, নিরাপত্তার দিক থেকে এবং অর্থনৈতিকভাবে বাড়াতে চাই।”
“আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। গত ৫১ বছরে দুই দেশের সম্পর্ক খুব শক্তিশালী হয়েছে এবং আগামী ৫১ বছর এবং তারপরেও সম্পর্ক শক্তিশালী করার চিন্তা করছি,” বলেন শোলে।
বৈঠকে বাংলাদেশের ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রকে বিনিয়োগেরও আহ্বান জানানো হয়েছে বলে জানান আব্দুল মোমেন।
রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারে ‘নিরাপদ অঞ্চলের’ প্রস্তাব
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশ এই অঞ্চলে যা করছে সেজন্য আমরা বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ; বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কাজ করার জন্য। মিয়ানমার থেকে আসা ১০ লাখের বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে দিয়েছে।”
রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় “বাংলাদেশকে সাহায্য করতে এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরের এই সংকটের মূল সমাধানে” যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
শোলে এবং তার নেতৃত্বে আসা প্রতিনিধিদলের সাথে “খুব ভালো আলোচনা হয়েছে” বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন।
বৈঠকে মূলত রোহিঙ্গা সংকট ও রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, রোহিঙ্গারা হতাশাগ্রস্ত জাতি। তারা মানবপাচার, মাদক চোরাকারবারির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। নিজেরা মারামারি করে।”
মন্ত্রী বলেন, “আমি তাদের বলেছি, আগামীতে তারা আরও নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি করবে যা আমাদের জন্য, এই অঞ্চলের জন্য এবং এর বাইরে প্রভাব পড়বে।”
সংকটের শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সবচে বেশি মানবিক সহায়তা দেয়াসহ সব বিষয়ে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে আসছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমি তাঁকে বলেছি, তোমরা কসোভোতে যেভাবে নিরাপত্তা অঞ্চল গঠন করেছ, রোহিঙ্গাদের জন্য সেরকম মিয়ানমারেও করতে পারো।”
তবে শোলে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার দেশ বসনিয়া হার্জেগোভিনা এবং শ্রীলঙ্কার ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা বিবেচনায় নিয়ে শরণার্থীদের রক্ষার জন্য “নিরাপদ অঞ্চল” গঠনের বিরোধিতা করে আসছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধান নিরাপদ অঞ্চল সৃষ্টির প্রস্তাব করেন। সেই সময়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে জানায়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বার্মা সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত নিষ্ঠুর কার্যক্রমের কথা বিবেচনায় নিলে নিশ্চিত করে বলা যায় তারা সেখানে কোনো নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করতে সম্মত হবে না।
সংস্থাটি জানায়, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বসনিয়া হার্জেগোভিনার সেব্রেনিসা শহরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল গঠন করা হয়। বসনিয়ান সার্বরা ওই নিরাপদ অঞ্চলে ঢুকে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং মুসলিম নারী ও শিশুদের ধর্ষণ করে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, শ্রীলঙ্কায় সরকারিভাবে ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চল কসাইখানায় পরিণত হয়: বিদ্রোহী তামিল টাইগার ইলম গেরিলারা সেখানে ঢুকে নিরপরাধ ব্যক্তিদের জিম্মি করে রাখে এবং সরকারি বাহিনীর গোলাবর্ষণে সেখানে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়।
অব্যাহত সমর্থনের ইঙ্গিত
নির্বাচন ও মানবাধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মন্তব্য ও সরকারের পাল্টা মন্তব্যের কারণে দুই দেশের সম্পর্ক “স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না” মনে হলেও ডেরেক শোলের এই সফর বর্তমান সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের “অব্যাহত সমর্থনের ইঙ্গিত” বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে অব্যাহত সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চাওয়ার অন্যতম কারণ “ভূ-রাজনৈতিক,” উল্লেখ করে বুধবার তিনি বেনারকে বলেন, “চীনের উত্থানের কারণে আমেরিকার কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।”
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার এবং মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে চীন। বাংলাদেশ এই সংকটের শিকার।”
“রোহিঙ্গা সঙ্কটের শুরু থেকে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে আসছে আমেরিকা। তাঁদের সমর্থন আমাদের দরকার,” বলেন শমসের মবিন চৌধুরী।
মঙ্গলবার দুই দিনের সফরে দক্ষিণ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে ঢাকা আসেন। তিনি চার সদস্যের মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রতিনিধি দলে আরও রয়েছেন মার্কিন উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি’র কাউন্সেলর ক্লিনটন হোয়াইট, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া অধিশাখার মুখ্য উপসহকারী সচিব এলিজাবেথ হর্স্ট এবং মার্কিন সরকারের বৈশ্বিক ফৌজদারি বিচার বিষয়ক অ্যাম্বাস্যাডর-অ্যাট-লার্জ বেথ ভ্যান শ্যাক।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মার্কিন প্রতিনিধিদল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কার্যক্রমের ইতিবাচক পরিবর্তনের বিষয়ে সাধুবাদ জানিয়ে টেকসই সংস্কারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে।
র্যাবকে একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও কার্যকরী আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান যে, এ সংস্থা ইতোমধ্যে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
মঙ্গলবার বিমান বন্দরে মার্কিন প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। বাংলাদেশ সফর শেষে শোলে পাকিস্তান সফর করবেন বলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।