সংসদে যুক্তরাষ্ট্র ও প্রথম আলোর কড়া সমালোচনা করলেন প্রধানমন্ত্রী

আহম্মদ ফয়েজ
2023.04.10
ঢাকা
সংসদে যুক্তরাষ্ট্র ও প্রথম আলোর কড়া সমালোচনা করলেন প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনের সমাপনীতে ভাষণ দিচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১০ এপ্রিল ২০২৩।
[সৌজন্যে: পিআইডি]

সংসদের একটি বিশেষ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার যুক্তরাষ্ট্র ও শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলোর কড়া সমালোচনা করেছেন।

আমেরিকা চাইলে যেকোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে পাল্টাতে পারে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তারা (আমেরিকা) দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে আবার দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়েই ওকালতি করে যাচ্ছে।”

“(যুক্তরাষ্ট্র) গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এখানে এমন একটা সরকার আনতে চাচ্ছে- তার গণতান্ত্রিক কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। অগণতান্ত্রিক ধারা। আর সেই ক্ষেত্রে আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবী, সামান্য কিছু পয়সার লোভে এদের তাঁবেদারি করে। পদলেহন করে,” বলেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে, কিন্তু তারা দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত ব্যক্তিদের পক্ষে কথা বলে আসছে। তিনি অবশ্য তাঁর বক্তব্যে এই দণ্ডিত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেননি।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির দুটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত।

শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের যারা হত্যা করেছে সেই খুনি রাশেদ (রাশেদ চৌধুরী) আমেরিকায় আশ্রয় নিয়ে আছে।

রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় না দেয়া ও বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বারবার আবেদন করার পরও যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ফেরত দিচ্ছে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশটি “খুনিদের লালন পালন করেই রেখে দিচ্ছে।”

সংসদে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন মন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক কূটনীতিক এম. হুমায়ুন কবির যিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন, বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য স্পষ্ট করেছে যে ওয়াশিংটন ও ঢাকার মধ্যে বোঝাপড়ার বিশাল গ্যাপ রয়েছে।”

কিন্তু এই দুটি দেশের মধ্যে চূড়ান্ত সম্পর্ক সম্পর্কে কিছু বলার জন্য এটি উপযুক্ত সময় নয় দাবি করে তিনি বলেন, “আমি মনে করি আমাদের এ সংক্রান্ত ঘটনা প্রবাহ আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার।”

বিশ্ববাসী বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর নেতিবাচক বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পরে দেশটির স্থানীয় সময় দুপুরে যুক্তরাষ্ট্র সফররত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।

সোমবার এক বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্রদপ্তর জানায়, বৈঠকের শুরুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, গত ৫০ বছরে অর্থনৈতিক, ও দুই দেশের জনগণের মধ্যে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক “অভাবনীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।”

পাশাপাশি দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেবার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন তিনি।

ভবিষ্যতেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো উন্নয়ন করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে ব্লিনকেন বলেন, “একই সাথে আমরা, এবং বিশ্ববাসী বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছি, যাতে ওই নির্বাচন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনের একটি আদর্শ উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।”

বিবৃতিতে জানানো হয়, নিজের প্রতিপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরোও ঘনিষ্ঠ হবার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

প্রথম আলো দেশের শত্রু: প্রধানমন্ত্রী

সংসদে দেয়া একই ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দৈনিক প্রথম আলো আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্র ও দেশের জনগণের শত্রু।

২৬ মার্চ, দেশের স্বাধীনতা দিবসে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে এক দিনমজুরের কষ্ট সংক্রান্ত মন্তব্যসহ একটি সংবাদ প্রকাশ করার পর থেকে দৈনিকটি ব্যাপক নেতিবাচক পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। সরকার সমর্থকরা ওই মন্তব্যকে দেশের স্বাধীনতার জন্য অবমাননাকর বলে চিহ্নিত করেছে।

এই ঘটনার পর প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া একটি মামলায় গ্রেপ্তার হন এবং পাঁচদিন কারাভোগ করে মুক্তি পান। জামিন পান দৈনিকটির সম্পাদক ও প্রকাশক মতিউর রহমানও।

স্বাধীনতা দিবসের দিন দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরটির প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা ছোট্ট শিশুর হাতে ১০ টাকা দিয়ে তাকে দিয়ে একটা মিথ্যা বলানো।

“শিশুর মুখ থেকে কিছু কথা বলানো। কী কথা! ভাত-মাছ-মাংসের স্বাধীনতা চাই। একটা সাত বছরের শিশু। তার হাতে ১০টা টাকা তুলে দেয়া এবং তার কথা রেকর্ড করে সেটা প্রচার করা- স্বনামধন্য এক পত্রিকা। খুবই পপুলার। নাম তার প্রথম আলো। কিন্তু বাস করে অন্ধকারে,” বলেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু, প্রথম আলো দেশের মানুষের শত্রু।”

এ সময়ে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা সংসদে সেইম, সেইম বলে চিৎকার করেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ বেনারকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে দৈনিকটির কোনো মন্তব্য নেই।

“তবে আমরা পেশাগত নৈতিকতা বজায় রেখে সাংবাদিকতা করছি, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমাদের কোনো রাগ বা অনুরাগ নেই,” বলেন তিনি।

প্রথম আলো ভবনে ঢুকে হুমকি

এদিকে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পর সন্ধ্যায় একদল দুর্বৃত্ত রাজধানী ঢাকার কাওরান বাজারে প্রথম আলো অফিস ভবনে ঢুকে নিরাপত্তারক্ষীকে হুমকি দেয়।

ভবনের নিরাপত্তারক্ষী মেসবাউল হক বেনারকে জানান, অন্তত চারজন যুবক সেখানে প্রবেশের পর বয়কট প্রথম আলোকে, বয়কট মতিউর রহমান বলে চিৎকার করে।

বিষয়টি সম্পর্কে শরীফ বলেন, প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ এটাকে একটি ‘ছোট ঘটনা’ হিসেবে দেখছে এবং এ বিষয়ে থানায় কোনো অভিযোগ করেনি।

রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আরও ২৩.৮ মিলিয়ন ডলার সহায়তা

এদিকে রোহিঙ্গাদের জরুরি খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি এর মাধ্যমে আরো ২৩.৮ মিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তা প্রদান করছে যুক্তরাষ্ট্র।

সোমবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এই নতুন অর্থায়নের মাধ্যমে কক্সবাজার ও ভাসানচরে শিশু, গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী মহিলাদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মৌলিক ও তাজা খাবার কেনার জন্য ইলেকট্রনিক ভাউচার, নয় লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গাদের খাদ্য যোগানসহ প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ করতে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সাথে কাজ করবে ইউএসএআইডি।

প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের তহবিলের ঘাটতির মধ্যে এই সহায়তা এমন সময়ে দেয়া হচ্ছে যখন রোহিঙ্গা শিবিরগুলিতে খাদ্য রেশন হ্রাস করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছিল, বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

এতে বলা হয়, এ প্রসঙ্গে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে উদ্বাস্তু ও ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়কে সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন আছে। আমরা অন্যান্য দাতাদের রোহিঙ্গাদের চাহিদা মেটাতে অতিরিক্ত সহায়তা প্রদান করতে আমাদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।