নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র

শৈলজা নীলাকান্তন
2023.04.11
ওয়াশিংটন
নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের (বাম থেকে দ্বিতীয়) সাথে বৈঠক করছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের (ডান থেকে তৃতীয়)। ১০ এপ্রিল ২০২৩।
[এএফপি]

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গণমাধ্যমের ওপর হুমকি, হামলা এবং কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

সোমবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে এক বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন জোরালোভাবে বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য একটি নিরপেক্ষ ও আইনসম্মত নির্বাচন এবং মানবাধিকারের প্রতি উচ্চ মাত্রায় শ্রদ্ধাশীল থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আসন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশে একটি অগণতান্ত্রিক দলকে ক্ষমতায় আনতে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করছে অভিযোগ এনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশটির কঠোর সমালোচনা করে সংসদে বক্তব্য দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ব্লিনকেনের এই মন্তব্যটি এলো।

দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বৈঠকে ব্লিনকেন বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। একই সাথে তিনি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার এবং মামলার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোও উল্লেখ করেন।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপ-মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বৈঠক সম্পর্কে বলেছেন, “মন্ত্রী ব্লিনকেন গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শন এবং এ কাজে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।”

“তিনি জোর দিয়ে বলেছেন বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমরা আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও গভীর করতে চাই।”

বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ করে। একই বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে। আইনটিতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে অনলাইনে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে শুধুমাত্র এমন সন্দেহের ভিত্তিতে ওয়ারেন্ট ছাড়াই মানুষকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার পাশাপাশি সংসদে দৈনিক প্রথম আলোরও সমালোচনা করেছেন। খাদ্যের উচ্চ মূল্যের বিষয়ে একজন নাগরিকের অভিযোগ প্রকাশ করায় “দেশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করার” অভিযোগে গত মাসে এই আইনের অধীনে দুটি মামলার শিকার হয়েছিল প্রথম আলো।

সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর আইন

জাতীয় সংসদে যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রথম আলোকে “জনগণের শত্রু” অভিহিত করে শেখ হাসিনার নিন্দা জানানো বিষয়ে মতামত জানতে চেয়ে সোমবার স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্রিফিংয়ে একের পর প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।

যুক্তরাষ্ট্র জোর করে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে মর্মে শেখ হাসিনার অভিযোগ এবং প্রথম আলোর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে মন্তব্য করতে বলেন একজন সাংবাদিক।

প্যাটেল যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে হাসিনার মন্তব্য নিয়ে কিছু বলেননি, তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা বলেছেন।

“গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংক্রান্ত সর্বশেষ তালিকায় বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১৬২তম। আগের বছরের তুলনায় দেশটি ১০ ধাপ নেমে গেছে। এর সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যা আমাদের মূল্যায়ন অনুসারে সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর আইনগুলির মধ্যে একটি,” সাংবাদিকদের বলেন তিনি।

“আমরা এই আইন সম্পর্কে আমাদের উদ্বেগগুলো বেশ স্পষ্ট করেছি। মুক্ত সংবাদমাধ্যম এবং সচেতন নাগরিক সমাজ যেকোনো জাতি ও তার গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই মিডিয়া এবং সুশীল সমাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।”

আরেকজন সাংবাদিক সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে বিএনপি’র “নিরপেক্ষ” তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান।

জবাবে প্যাটেল বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও গভীর করার অপেক্ষায় রয়েছে, সে কারণেই ব্লিনকেন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্বে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নীতিকে সমর্থন করে, কিন্তু আমি এখানে একজন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী বা তার বিপরীতে অন্য দলকে সমর্থন করতে আসিনি,” বলেন তিনি।

শেখ হাসিনা সোমবার বিশেষ কোনো কথিত অগণতান্ত্রিক দলের নাম উচ্চারণ করেননি যে দলটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতায় আনতে চায় বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজদের সমর্থন করার জন্যেও ওয়াশিংটনকে অভিযুক্ত করেন।

হাসিনা এক্ষেত্রেও কারও নাম উচ্চারণ করেননি; তবে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দুর্নীতির দুটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সরকারের সমালোচক এবং বিরোধীদের মুখ বন্ধ করা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে একাধিকবার আহ্বান জানিয়েছে।

বিরোধীরা বলছেন, শেখ হাসিনার প্রশাসন তার সমালোচক এবং সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ও নির্লজ্জভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র ও নিপীড়নমূলক আইন ব্যবহার করছে। বিষয়টি অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলিরও নজরে এসেছে।

বিশ্লেষকরা উদাহরণ হিসেবে সরকারের সমালোচক, বিশেষ করে সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট, অধিকার কর্মী, উদ্যোক্তা, শিক্ষাবিদ এবং ছাত্রদেরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের লক্ষ্যবস্তু বানানোর কথা তুলে ধরছেন।

সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের তথ্য মতে ২০১৮’র অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রায় ২৮০ জন সাংবাদিককে এই আইনের অধীনে আসামি করা হয়েছিল এবং ৮৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় স্পষ্টভাবে উঠে আসে, শাসক দলের সদস্যদের দ্বারা সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের টার্গেট করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হচ্ছে।

গত বছরের পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও, বাংলাদেশে ২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলা আগের বছরের তুলনায় প্রায় নয় গুণ বেড়েছে।

অধিকার সংস্থাগুলোর মতে, অনলাইনে শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু এবং সরকারের নেতৃবৃন্দের সমালোচনার জন্য এই মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছিল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।