রাজনীতির নতুন আলোচনা সেন্টমার্টিন, সরকারদলীয় শরিকদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র এটা চায়

আহম্মদ ফয়েজ
2023.06.22
ঢাকা
রাজনীতির নতুন আলোচনা সেন্টমার্টিন, সরকারদলীয় শরিকদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র এটা চায় কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপ সংলগ্ন জলসীমায় টহলরত কোস্টগার্ডের একটি জাহাজ। ২২ অক্টোবর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশের নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে সম্প্রতি নানাভাবে সক্রিয় হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিতে চায়—এমন আলোচনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

চলতি সপ্তায় জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের শরিক দলের নেতা হাসানুল হক ইনু অভিযোগ করেন যুক্তরাষ্ট্র “বঙ্গোপসাগরে সামরিক অবস্থান নেয়ার পাঁয়তারা করছে।" অন্য শরিক নেতা রাশেদ খান মেনন বলেন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ চায়।

সংসদে এই বক্তব্যের পর বুধবার সংবাদ সম্মেলনে কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কাউকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ দিয়ে তাঁর দল ক্ষমতায় থাকতে চায় না।

বিরোধী দল বিএনপি এই দ্বীপটি মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায় কি না সেই প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর তোলা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর “এসব বক্তব্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সুবিধা নিতে চায়” মন্তব্য করে বেনারকে বলেন, “চুক্তি কখনো বিরোধী দলের সঙ্গে হয় না, হয় দেশের সঙ্গে।”

“প্রধানমন্ত্রী কেন এমন মন্তব্য করেছেন তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। কোনো কিছু মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার ধারণায় বিএনপি বিশ্বাস করে না। উনি করেন হয়তো,” বলেন মির্জা ফখরুল।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দ্বীপ চেয়েছে কি না তা জানা নেই বলে বেনারকে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ফারুক খান।

“এই ধরনের প্রস্তাব আমাদের পর্যায়ে আলোচনা হয়নি। এমন প্রস্তাব এলে তা উপরের মহলে আসতে পারে,” বলেন ফারুক খান।

এ বিষয়ে বক্তব্য চেয়ে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে বেনারের পক্ষ থেকে ই-মেইল পাঠিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে গত ১৪ জুন সংসদে রাশেদ খান মেননের দেওয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় দৈনিক মানব জমিনকে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলর শন ম্যাকটিনশেট বলেছেন, “আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করি। দেশটির কোনো ভূ-খণ্ডের ওপর আমরা কোনো দাবি করিনি।"

যুক্তরাষ্ট্র কখনো বাংলাদেশের কাছে কোনো ভূ-খণ্ড দাবি করেছে কি না— বেনারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এমন প্রশ্ন পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

চলতি বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

এই নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় তার জন্য গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য আলাদা ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় দেড় বছর আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর কিছু উচ্চপদস্থ ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।

যে কারণে সেন্টমার্টিন গুরুত্বপূর্ণ

যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দ্বীপে “কোনো সুবিধা চায় প্রকাশ্যে এমন কোনো বিবৃতি কখনো দেখা যায়নি,” বলে বেনারকে জানান সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন।

তবে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত কক্সবাজার জেলার এই দ্বীপটি “এই অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে গুরুত্বপূর্ণ,” বলে জানান তিনি।

সেন্টমার্টিন দ্বীপ নানা সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে দেখা গেছে।

এ প্রসঙ্গে তৌহিদ হোসেন বলেন, “বার্মা এলাকা দিয়ে চীন যে রুট তৈরি করেছে সেই বিবেচনায় এই দ্বীপটিকে আমেরিকা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে থাকতে পারে।”

“কোনো সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হলে আমেরিকার যদি সেন্টমার্টিন দ্বীপে অবস্থান থাকে সেটি আমেরিকার জন্য ইতিবাচক হতে পারে। এসব বিবেচনায় নিয়েই হয়তো দ্বীপটি প্রায়শই আলোচনায় আসে,” বলেন এই কূটনীতিক।

তাঁর মতে “আমেরিকার জন্য দ্বীপটি প্রয়োজন” এমন প্রচারণা থাকার কারণেই হয়তো “ক্ষমতাসীনরা জাতীয়তাবাদী মনোভাব সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করে।”

অতীতেও সেন্টমার্টিন প্রসঙ্গ বাংলাদেশে আলোচনায় এসেছে বলে বেনারকে  জানান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান। তবে তাঁর মতে,  “আমেরিকা এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত কিছু চায় না।”

তিনি বলেন, “যেসব দেশে আমেরিকা বেজ করেছে, তার প্রক্রিয়াটা দেখলে দেখা যাবে, সেসব দেশে যুক্তরাষ্ট্র বেজ তৈরি করার আগে দীর্ঘ মেয়াদি আলোচনা হয়েছে, বিশদ চুক্তি হয়েছে এবং সেগুলো প্রকাশ্যে হয়েছে।”

প্রসঙ্গত, গত মে মাসে প্রশান্তমহাসারীয় দেশ পাপুয়া নিউ গিনি দেশটির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও নৌঘাঁটিগুলো ‘অবাধে’ ব্যবহারের জন্য মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য উন্মুক্ত করে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। 

গত কয়েক দশক ধরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে বাণিজ্য, অবকাঠামো ও সহায়তা খাতে চীন অন্যতম প্রধান উৎস। এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক ব্যবহার করে চীন তাইওয়ানকে অনেক দিন ধরেই অন্যান্য দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে,  পাপুয়া নিউ গিনির সাথে এমন চুক্তি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য মোকাবেলার কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যাবে।

এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সম্প্রসারিত প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় ফিলিপাইন দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ১৪টি সামরিক প্রকল্প গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে।

প্রকল্পস্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে, ভৌগলিকভাবে তাইওয়ানের মুখোমুখি দুটো এলাকা এবং দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত একটি এলাকা।

এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রশান্তমহাসারীয় অঞ্চলের চ্যালেঞ্জগুলো অন্যদের সাথে মিলে ‘অধিকতর নিখুঁতভাবে’ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে বলে গত এপ্রিলে এক বিবৃতিতে জানায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর।

সেন্টমার্টিন ‘নৌঘাঁটির জন্য উপযুক্ত নয়

সম্প্রতি সংসদে রাশেদ খান মেনন সেন্টমার্টিন নিয়ে মন্তব্য করার কারণেই মূলত এই বিষয়টা সামনে এসেছে বলে বেনারকে জানান সুশাসন নিয়ে কাজ করা অবসরপ্রাপ্ত সচিব আবু আলম শহীদ খান।

সেন্টমার্টিন দ্বীপ আমেরিকা চায় এমন কোনো ডকুমেন্ট “আমরা দেখিনি” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সেন্টমার্টিন কেন চাইবে তারা!”

সেন্টমার্টিন আমেরিকা চাইলে নৌঘাঁটি করার জন্যই চাইতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আনুমানিক ৯৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপটিতে

“নানা বিবেচনাতেই” নৌঘাঁটি করা সম্ভব না।

“সেন্টমার্টিনের ওই ক্যাপাসিটি নেই। সেন্টমার্টিন কোনো নেভাল বেজ করার জন্য উপযোগী না,” বলেন আবু আলম শহীদ খান।

তিনি বলেন, “আমি জানি না আমাদের রাজনীতিবিদরা কোথায় এটা পেলেন!”

জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সরকার সেন্টমার্টিন ইস্যুকে সামনে এনেছে বলে বৃহস্পতিবার এক যৌথ বিবৃতিতে অভিযোগ করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল।

তাঁরা বলেন, যদি সত্যি সত্যিই কেউ সেন্টমার্টিন চেয়ে থাকে তাহলে সেটা সরকারের স্পষ্ট করে বলা দরকার, জনগণকে জানানো দরকার কে, কবে এটা চেয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।