বাসায় ফিরলেন গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নেয়া বরখাস্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল

পরিবারসহ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নেয়া সদ্য বরখাস্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
পরিবারসহ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নেয়া সদ্য বরখাস্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩। ([ছবি: ডেইলি স্টার])

গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় শুক্রবার পরিবারসহ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নেবার কয়েক ঘণ্টা পর ‘সরকারের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে’ বাসায় ফিরেছেন সদ্য বরখাস্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া।

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘বিচারিক হয়রানি’র শিকার হচ্ছেন-এমন মন্তব্য করার কয়েকদিন পর শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে বৃহস্পতিবার এমরানকে বরখাস্ত করে সরকার।

শুক্রবার সকালে তাঁর বরখাস্তের বিষয় জানাজানি হবার পর বিকেলে তিন কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নেন তিনি।

“বরখাস্তের পর গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলাম। গ্রেপ্তার করা হবে না বলে আশ্বাসের পর বাসায় ফিরেছি,” বাসায় ফেরার সময় সাংবাদিকদের জানান এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া।

শুক্রবার বিকেলে এমরান ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে পরিবারসহ আশ্রয় নিতে গেছেন বলে ঢাকার দুটি ইংরেজি দৈনিক ও একাধিক বাংলা দৈনিক খবর প্রকাশ করে।

ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়, “এক ক্ষুদেবার্তায় তিনি বলেন, আমি মার্কিন দূতাবাসে আজকে পুরো পরিবারসহ আশ্রয়ের জন্য বসে আছি। বাইরে পুলিশ। আজকে আমাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে...।”

ঢাকার আরেকটি ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এমরান আহম্মদ ভূঁইয়ার বরাত দিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলে, “শুক্রবার দূতাবাস বন্ধ থাকায় আমরা এখন রিসেপশন এরিয়ায় অপেক্ষা করছি।”

ডেইলি স্টার পরিবারসদস্যসহ এমরানের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে অবস্থানকালীন একটি ছবিও প্রকাশ করেছে।

“আমার ফেসবুক মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে গত ৪-৫ দিন যাবত অনবরত হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে। এই সরকার ভালোবাসার প্রতিদান দেয় জেল দিয়ে,” ডেইলি স্টারকে বলেন এমরান।

এমরানের যুক্তরাষ্ট্র যাবার কোনো ভিসা নেই, তিনি তাঁর তিন মেয়ে ও স্ত্রীসহ ‘এক কাপড়ে’ বের হয়ে মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছেন বলেও ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়।

এদিকে শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার দিকে এমরান বাসায় ফিরেছেন বলে বেনারের কাছে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মো. শহিদুল্লাহ।

তিনি বলেন, এমরান “হয়তো কোনো কাজে দূতাবাসে এসেছিলেন। দুই ঘণ্টা আগে বাসায় চলে গেছেন। এখন বাসায় অবস্থান করছেন।”

বেনারের পক্ষ থেকে এমরান আহম্মদের সঙ্গে মোবাইল ফোন ও ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বেনারকে বলেন, “এই মুহূর্তে আপনাদের জানানোর মত কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।”

এদিকে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে যোগাযোগ করা হলেও তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

08-BD-embassy2.jpeg
সদ্য বরখাস্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে একটি গাড়ি ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩। [বেনারনিউজ] (Sony Ramany)

' বাকস্বাধীনতার দুর্বল অবস্থা '

গত ৭ সেপ্টেম্বর আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর বিভাগের সলিসিটর রুনা নাহিদ আকতার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভুঁইয়ার নিয়োগ আদেশ ‘জনস্বার্থে’ বাতিল করে তাঁকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।

তাঁর নিয়োগ বাতিলের বিষয়টি নিশ্চিত করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

শুক্রবার নিজের নির্বাচনী জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “গত তিনদিন যাবত অপেক্ষা করেছি, তিনি পদত্যাগ করেননি। সেজন্য বরখাস্ত করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “এটা নিয়ম যে সরকারি চাকরিতে থাকলে প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে কোনো বক্তব্য দিতে হয়। তিনি সেই শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন এবং পদে থেকে সরকার সম্পর্কে মিথ্যাচার করেছেন।”

এমরানের বরখাস্তের ঘটনা “বাকস্বাধীনতার দুর্বল অবস্থা মনে করিয়ে দেয়,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন খ্যাতনামা আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের বরখাস্ত হওয়া ও দূতাবাসে আশ্রয় চাইতে যাওয়া ভয়ের সংস্কৃতির বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়।

তাঁর মতে, এমরানের দূতাবাসে আশ্রয় নিতে যাওয়া প্রমাণ করে, “সরকারের সাথে থাকলে কোনো ভয় নেই। আর সাথে না থাকলে যে ভয়ের আবরণে আচ্ছাদিত” হয়ে পড়তে হয়, “এটি তার নিদর্শন।”

ড. ইউনূস প্রসঙ্গে “একটি মতামতের জন্য” পদ থেকে বরখাস্ত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে “বাকস্বাধীনতার দুর্বল অবস্থা” মনে করিয়ে দেয় বলেও জানান শাহদীন মালিক।

তিনি বলেন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলরা সরকারির কোষাগার থেকে বেতন পাওয়া ছাড়া সরকারি চাকরির আর কোনো শর্ত পূরণ করেন না। “তাঁরা পদে থেকে নির্বাচনও করতে পারেন।” তাঁদের বিরুদ্ধে “প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো বিধিমালাও নেই।”

এই কারণে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলদের ক্ষেত্রে “সরকারি চাকরির আর কোনো শর্ত “প্রযোজ্য নয়” এবং তাঁরা “নিজস্ব মতামত দিতে পারেন” বলে মনে করেন শাহদীন মালিক।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে

গত ৪ সেপ্টেম্বর এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিকদের বলেন, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘সম্মানিত ব্যক্তি’ এবং তিনি ‘বিচারিক হয়রানির’ শিকার হচ্ছেন।

ড. ইউনূসকে হয়রানি না করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ১৬০ জনের বেশি নোবেল বিজয়ী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অনেকেই বিবৃতি দিয়েছেন জানিয়ে এমরান ওইদিন সাংবাদিকদের বলেন, ওই বিবৃতির প্রতিবাদে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে একটি বিবৃতি দেওয়ার কথা রয়েছে।

“নোটিশ দেওয়া হয়েছে, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে কর্মরত সবাইকে সেই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে হবে। …আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করব না,” সাংবাদিকদের বলেন এমরান।

এই ঘটনার পরই এমরান সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন জানিয়ে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, তাঁকে চাকুরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।