যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে চায় বাংলাদেশ
2024.02.26
ঢাকা
মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচার বহির্ভূত হত্যা, বিরোধীদলের ওপর নিপীড়ন ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্যমান মতবিরোধ পেছনে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে চায় বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের (এনএসসি) দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লুবাখারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের মার্কিন প্রতিনিধিদলের সাথে সাক্ষাতের পর বাংলাদেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এ কথা বলেছেন।
গত শনিবার আসা প্রতিনিধি দলটি সোমবার ঢাকা ত্যাগ করেছে। দলের অন্য সদস্যরা হলেন; যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) সহকারী প্রশাসক মাইকেল শিফার।
মার্কিন প্রতিনিধি দলের সাথে “খোলামেলা” আলোচনা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সোমবার বেনারকে বলেন, “আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে চাই। তারাও চায় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে। সুতরাং কোনো সমস্যা নেই।”
গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এটিই ছিল বাংলাদেশ সফর করা মার্কিন সরকারের প্রথম প্রতিনিধি দল। তবে তাঁরা গণমাধ্যমের মুখোমুখি হননি।
তিনদিনের এই সফরে তাঁরা প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শ্রমিক প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
সাংবাদিকেরা জানতে চাইলেও বিরোধী দল বিএনপি'র পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে বৈঠকে আলোচনার বিষয় সম্পর্কে কোনো কিছু জানানো হয়নি।
গুরুত্ব পেল র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গ
এলিট ফোর্স র্যাবের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচটি পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সেগুলো অনুসরণ করবে।
পর্যবেক্ষণগুলো কী কী-এমন প্রশ্নের জবাবে ড. হাছান মাহমুদ বেনারকে বলেন, “আমরা এগুলো দেখিনি। সেগুলো র্যাবকে দেয়া হয়েছে। সরকার সেই পর্যবেক্ষণ নিয়ে কাজ করছে। আশা করি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে মার্কিন সরকার।”
র্যাবের ওপর যখন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তখন আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এ.কে. আব্দুল মোমেন।
সোমবার আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, “আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে র্যাবের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য কাজ শুরু করে সরকার। কীভাবে এই অবরোধ প্রত্যাহার করা যায়, সে বিষয়ে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইনজীবী নিয়োগ করি। তিনি আমাদের কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো র্যাবকে পাঠানো হয়েছে।”
যোগাযোগ করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সোমবার বেনারকে বলেন, “আমি শুনেছি মার্কিন সরকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে পাঁচটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। এগুলো এখনও আমার হাতে আসেনি। আসলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
র্যাব সংক্রান্ত পাঁচ পর্যবেক্ষণ বিষয়ে মার্কিন প্রতিনিধিদলের মন্তব্যের জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে ই-মেইল করে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে বৈঠক শেষে মার্কিন দূতাবাস এক পৃথক বার্তায় জানায়, “অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নিরাপত্তা, শরণার্থী, জলবায়ু, শ্রম ও বাণিজ্যসহ পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাদের দুই দেশ কীভাবে কাজ করতে পারে তা নিয়ে আমরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি।”
এতে বলা হয়, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
যোগাযোগ করা হলে বৈঠকের বিষয়ে প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করে র্যাবের প্রসঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেনারকে জানান, “নীতিগত কারণে গোপনীয় কূটনৈতিক আলোচনার বিষয়বস্তু আমরা প্রকাশ করি না।”
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেশটির ট্রেজারি বিভাগ কর্তৃক বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব ও এর সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন অবরোধ বড়ো বাধা হিসেবে কাজ করছে।
২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের অভিযোগ ওঠার পর ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা প্রত্যাহারের জন্য মার্কিন সরকারকে অনুরোধ করে আসছে বাংলাদেশ।
তবে সরকার বরাবর এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে এবং মার্কিন সরকারের এই অভিযোগ একতরফা বলে উল্লেখ করছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাগিদ দিয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কের টানাপোড়েন নির্বাচনের আগে প্রকট হয়ে ওঠে।
তবে এই অবস্থানের জন্য ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি-কে ক্ষমতায় আনতে কাজ করছে। আর মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমেরিকা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে, কোনো নির্দিষ্ট দলের পক্ষে নয়।
‘মার্কিন অবস্থান পরিবর্তন হয়নি’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার ব্যাপারে মার্কিন সরকারের অবস্থান পরিবর্তন হয়নি।
বিরোধী দল বিএনপির বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগেই জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির সোমবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকারের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন অবস্থান স্পষ্ট।”
“তবে মার্কিন সরকার এগুলো নিয়ে এখন কথা বলছে না। যেসব বিষয়ে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক সেসব বিষয় নিয়ে তারা বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে চাচ্ছে,” বলেন হুমায়ূন কবির।
আলোচিত বিষয়ের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন উল্লেখযোগ্য জানিয়ে তিনি বলেন, “একইসাথে মার্কিন সরকার একটি বার্তা দিয়ে গেছে যে, তারা গণতন্ত্র, শ্রম অধিকার, সুশীল সমাজ ও মত প্রকাশের বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি।”
“তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। আমরা এখন উন্নয়নের দিকে যাচ্ছি। এই উন্নয়নের ধারা টেকসই এবং অর্থবহ করতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে,” বলেন হুমায়ূন কবির।
বাইডেনকে হাসিনার চিঠি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ মাসের শুরুতে চিঠি লিখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ওই চিঠির জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সোমবার বিকেলে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন।
চিঠির একটি অনুলিপি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জ্যেষ্ঠ পরিচালকের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। মূল চিঠি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হোয়াইট হাউসে পৌঁছে দেবেন।