ট্রাম্পের বিজয়ে খুশি আওয়ামী লীগ, সুসম্পর্কে আশাবাদী অন্তর্বর্তী সরকার
2024.11.06
ঢাকা
মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা মনে করেন, শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের বন্ধুত্ব থাকায় বাংলাদেশের ওপর নয়াদিল্লী ও ওয়াশিংটনের চাপ বাড়বে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নেতৃত্ব পরিবর্তন হলেও তা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে খুব একটা প্রভাব ফেলে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখতে পারে ওয়াশিংটন। তবে দেশটি কোনো বিশেষ দল অথবা ব্যক্তিকে আলাদাভাবে সমর্থন করার সুযোগ কম।
ট্রাম্পের বিজয়ের খবরে সন্তোষ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বুধবার রাতে বেনারকে বলেন, “ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ায় আমরা খুশি।”
বর্তমানে আওয়ামী লীগের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করা এই নেতা অজ্ঞাত স্থান থেকে আরও বলেন, “মার্কিন নির্বাচনের দুই দিন আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা নিয়ে যে টুইট করেছেন; তা দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন তিনি বাংলাদেশে সকল সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের পক্ষে, শান্তির পক্ষে।”
তিনি বলেন, “ট্রাম্পের এই অবস্থানের কারণে আমরা আশা করতে পারি যে, তিনি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সকল ধর্ম ও মতের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সমর্থন দিয়ে যাবেন।”
“বাইডেন প্রশাসনের সমর্থনে অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের অনির্বাচিত সরকার প্রধান হয়েছেন,” উল্লেখ করে বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, “তিনি সেই সমর্থন আর পাবেন না বলে মনে হয়।”
আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতা-কর্মীদের প্রায় সবাই গা ঢাকা দিলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। সেখানে তাদের বক্তব্য বা স্ট্যাটাসে ট্রাম্পের বিজয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছে।
ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেনারকে বলেন, “আমরা কোনো নির্দিষ্ট দল অথবা ব্যক্তির সাথে কাজ করি না। আমরা দেশ ও সে দেশের জনগণের সাথে সম্পর্ক রেখে কাজ করি।”
“আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সাথে একসাথে কাজ করতে প্রস্তুত,” বলেন মির্জা ফখরুল।
‘যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থই প্রাধান্য পাবে’
ট্রাম্পের সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ।
তাঁর মতে ট্রাম্পের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির “ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো” হবার কারণে হয়তো “বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের মতামতকে প্রাধান্য দিতে পারেন ট্রাম্প।”
“তবে তার অর্থ এই নয় যে, ড. ইউনূসকে সরিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে ট্রাম্প প্রশাসন,” বলেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকতে গেলে জনগণের সমর্থন নিয়েই থাকতে হবে। বিদেশি শক্তি কাউকেই ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে না।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট হুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল চাওয়া হলো এদেশে নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংস্কার করা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যতক্ষণ সেই লক্ষ্যে সঠিক কাজ করে যাবে ততদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাবে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব আনাম খানের মতে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা “কিছু না কিছু আছে” তবে অনেক সময়ই তা “খুব বেশি সরলীকরণ” করে ফেলা হয়।
তিনি বেনারকে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে সামগ্রিক পররাষ্ট্র নীতি তৈরি ও প্রয়োগ হয়, তা “অনেক বেশি জটিল” হলেও সেখানে “এক ধরনের ভারসাম্য থাকে।”
ভারতের সাথে মার্কিন সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি বাইডেন প্রশাসনের তুলনায় ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের মধ্যে এক ধরনে মতৈক্য হওয়া সম্ভব। উল্লেখ করে তিনি বলেন “তবে সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থই প্রাধান্য পাবে।”
“শুধু ট্রাম্পের একা সিদ্ধান্তে যে সবকিছু হবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই,” বলেন সাহাব আনাম খান।
ড. ইউনুসের শুভেচ্ছা
যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এক চিঠিতে তিনি বলেন, “২০২৪ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আপনি বিজয়ী হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাতে পেরে আমি আনন্দিত। আপনাকে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা মানে আপনার নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।”
“আমি নিশ্চিত আপনার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র সমৃদ্ধি লাভ করবে এবং বিশ্বজুড়ে অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে,” বলেন অধ্যাপক ইউনূস।
“বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অসংখ্য ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি আমাদের অংশীদারিত্ব আরও জোরদার করতে এবং টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যাশায় রয়েছি।”
মোদির অভিনন্দন, সম্পর্ক এগিয়ে নেবার আশাবাদ চীনের
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ লেখেন, “আপনি আপনার আগের মেয়াদের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে জয় পেয়েছেন। আমি ভারত-মার্কিন বিস্তৃত বৈশ্বিক এবং কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করতে আমাদের সহযোগিতা নবায়নের অপেক্ষায় রয়েছি।”
নিজেদের জনগণের উন্নতির জন্য এবং বিশ্ব শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য একসঙ্গে কাজ করার আহবান জানান মোদি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান' আশা করছে চীন। নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ের বিষয়টি যখন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল ঠিক সেই সময় চীনের তরফ থেকে এমন আশাবাদ প্রকাশ করা হয় বলে জানায় কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
বুধবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং এক নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলেন, "আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সহযোগিতার নীতির ভিত্তিতে চীন-মার্কিন সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।”
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২০ সালের পুনর্নির্বাচনে তিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে হেরে যান। ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য বিজয়ী হন ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প।
ট্রাম্পের সাথে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ৪০ বছর বয়স্ক জে ডি ভ্যান্স।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতিদের মেয়াদ শুরু হয় ২০ জানুয়ারি থেকে। সে হিসেবে আগামী বছর জানুয়ারির ২০ তারিখ দেশটির ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।