বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বসালো স্যানিটারি প্যাডের মেশিন, কার্ড স্ক্যানে বের হচ্ছে প্যাড
2022.04.07
ঢাকা

নানা ধরনের কুসংস্কারের কারণে মাসিক ঋতুচক্র বা পিরিয়ডকালীন স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য মোটেই সহজ নয়। বিষয়টি নিয়ে এখনো অনেক পিতামাতাও মেয়েদের সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। ফলে মাসিক চলাকালীন সময়ে নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অনেক কিশোরীই লজ্জা ও ভয়ে বিষয়টি চেপে যান, স্কুলও কামাই করেন।
তবে এবার মাসিক ঋতুচক্রের সময় ভোগান্তি এড়াতে ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে দারুণ এক নজির স্থাপন করেছেন ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের এসএসসি বিদায়ী শিক্ষার্থীরা।
নিজেরা চাঁদা তুলে স্কুলের জন্য উপহার হিসাবে একটি স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন উপহার দিয়েছেন তাঁরা। এই মেশিনে একটি কার্ড স্ক্যান করলেই বেরিয়ে আসবে স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড।
শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগে রীতিমত উচ্ছ্বসিত স্কুলটির শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
যে কয়েকজনের ভাবনা থেকে এই মেশিন দেওয়া হয়েছে, তাঁদের একজন আফরিনা নওশিন বেনারকে জানান, “এই বিদ্যালয়টিতে আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করেছি। বিদায় বেলায় স্কুলের জুনিয়র শিক্ষার্থীদের কিছু উপহার দেওয়ার কথা আমরা সবাই মিলে ভাবছিলাম।”
“নিজেদের মধ্যে আলাপের এক পর্যায়ে আমরা জানতে পারি ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের ওয়াশরুমে হাইজিন স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন আছে। সেই ধারণা থেকে নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই উপহার দেওয়ার কথা ভাবা হয়। আমরা ১৩৬ জন শিক্ষার্থী মিলে ১৮০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে হাইজিন স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন কিনে উপহার দিই,” বলেন স্কুলটির বিদায়ী এই শিক্ষার্থী।
নিজেদের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বিদায়ী শিক্ষার্থী নাবিহা জান্নাত প্রিয়তি বলছিলেন, “অনেকেরেই বেশ ছোটবেলায় পিরিয়ড হয়। আর এই সময়টাতে যথাযথ ব্যবস্থা না নিতে পারায় নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। হঠাৎ করে পিরিয়ড হলে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। আশা করি এখন সে পরিস্থিতিতে পড়বে না কেউ।”
“লজ্জা না পেয়ে প্রয়োজন হলে সহজেই প্যাড নিয়ে সুরক্ষিত থাকতে পারবে,” বলেন এই শিক্ষার্থী।
এ ধরনের উদ্যোগ আরো প্রয়োজন
ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সরকারি বিদ্যাময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে দুই হাজার ১১৯ জন ছাত্রী রয়েছে।
বিদায়ী শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগ সম্পর্কে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছিমা আক্তার বেনারকে বলেন, “আমাদের শিক্ষার্থীরা কত এগিয়ে তাদের এই চিন্তা থেকেই বোঝা যায়। এমন উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। বিদ্যালয়ের ছোট বোনদের কথা ভেবে দারুণ এই উদ্যোগ তারা নিয়েছে। তাদের শিক্ষক হিসেবও আমি গর্বিত।”
“তাদের এই উদ্যোগ পিরিয়ড সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার পাশাপাশি পিরিয়ডকালীন সময়ে স্কুলে অনুপস্থিতি কমাবে। প্যাডের ব্যাবহার শিক্ষার্থীদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করবে,” বলেন তিনি।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত মেশিনটি প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ করে কেনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও ওয়াইফাই দ্বারা চালিত মেশিনটি বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে স্থাপন করা হয়েছে। যাতে শিক্ষার্থীরা স্বাচ্ছন্দ্যে এটি ব্যবহার করতে পারে।
কিশোরীদের পিরিয়ডকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংস্থা রেড অরেঞ্জ মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন। প্রতিষ্ঠানটির প্রোগ্রাম প্রধান নাকিব রাজিব আহমেদ বেনারকে বলেন, “বিদ্যাময়ীর শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগ অন্য স্কুলের শিক্ষার্থীরাও ভাবাবে। এ ধরনের উদ্যোগ আরো ব্যাপক পর্যায়ে নেওয়া প্রয়োজন। তাহলে পিরিয়ড সম্পর্কে যে সামাজিক ট্যাবুগুলো আছে তা দূর হবে।”
“প্যাড তৈরির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে সরকার কর এবং লেভি মওকুফ করেছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন মেশিনারিজের ক্ষেত্রেও এ ধরনের উদ্যোগ দরকার। মেশিনগুলো সহজলভ্য হলে অন্য স্কুলগুলোতেও তা বসানো যাবে। এতে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।”
স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, মেশিনটিতে একবারে ২০টির মতো সুরক্ষা প্যাড রাখা হয়। প্যাড শেষ হলে আবার স্কুল কর্তৃপক্ষ রিফিল করে দেবে। নির্দিষ্ট একটি কার্ডের মাধ্যমে মেশিনটি থেকে প্যাড সংগ্রহ করা যাবে। নারী শিক্ষক ও ক্লাস ক্যাপ্টেনদের কাছে এই কার্ড রয়েছে। ওই কার্ড নিয়ে মেশিনের নির্দিষ্ট স্থানে ধরলেই বেরিয়ে আসবে স্যানিটারি প্যাড। স্কুলে আসার পর যে কারও পিরিয়ড হলে তাঁরা সহজেই সেবাটি পাবে।
ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মৌসুমি সাহা বেনারকে বলেন, “আমরা কিশোরী বয়সে প্যাডের ব্যবহার জানতাম না। পিরিয়ড হলে পুরাতন কাপড় ব্যবহার করতে দিত মায়েরা। পিরিয়ডের দিনগুলোতে সাধারণত স্কুলে যেতাম না। পিরিয়ড ছিল আমাদের কাছে লজ্জার এবং অত্যন্ত গোপন বিষয়।”
“কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে তার প্রমাণ বিদ্যাময়ীর বিদায়ী শিক্ষার্থীদের স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন বসানোর উদ্যোগ। এভাবেই মেয়েরা নিজেরা নিজেদের সুরক্ষিত করতে ভূমিকা রাখবে,” বলেন তিনি।
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী অগ্নিলা ঘোষ বেনারকে বলেন “বড়ো আপুদের এই উপহার পেয়ে আমরা সত্যি মুগ্ধ। স্কুলে এসে পিরিয়ড হলে অনেক সময় আমরা লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারিনি। ভিন্ন অজুহাতে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে চলে গেছি। এখন তেমনটি আর হবে না।”