সমালোচনার মুখে উদ্বোধনের পরই কক্সবাজারে নারী পর্যটকদের ‘সংরক্ষিত এলাকা’ বন্ধ
2021.12.29
ঢাকা ও কক্সবাজার
সম্প্রতি কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে এক নারী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হবার প্রেক্ষিতে সমুদ্রসৈকতে নারীদের জন্য ‘সংরক্ষিত এলাকা’ উদ্বোধনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সমালোচনার মুখে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
দুপুরে উদ্বোধনের প্রায় নয় ঘণ্টার মাথায় এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলো প্রশাসন।
“আমরা পর্যটকদের সাথে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং পর্যটকদের প্রতিক্রিয়ার জন্য সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছি,” বেনারকে বলেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আমিন আল পারভেজ।
ওই নারী ধর্ষণের শিকার হবার পর সেখানকার প্রশাসন নারী পর্যটকদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা’ করার যে ঘোষণা দিয়েছিল তা নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা চলছিল। বুধবার দুপুরে সমুদ্র সৈকতের লাবনী পয়েন্টে এই ‘সংরক্ষিত এলাকা’ উদ্বোধন করেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ।
অধিকার কর্মী ও নারী পর্যটকরা বলছেন, এই উদ্যোগ যেমন হাস্যকর ও বৈষম্যমূলক তেমনই রয়েছে এর নানা নেতিবাচক দিক।
গত ২২ ডিসেম্বর রাত দুইটার দিকে ধর্ষণের শিকার নারীকে ওই গেস্ট হাউজ থেকে উদ্ধার করে র্যাব। ওই ঘটনার সাত দিনের মাথায় নারী পর্যটকদের জন্য ‘সংরক্ষিত এলাকা’ করার উদ্যোগ নেয় প্রশাসন।
‘সংরক্ষিত এলাকা’ উদ্বোধনকালে জেলা প্রশাসক বলেন, কক্সবাজারের প্রশাসন সৈকতে নারী ও শিশুদের বিশেষ সুরক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। এই জোনে নারী পর্যটকেরা নির্বিঘ্নে আনন্দে মগ্ন থাকবেন।
“আমরা কক্সবাজারকে পর্যটনবান্ধব করতে অনেক কাজ করছি। ছোট ছোট এই উদ্যোগগুলো পর্যটন খাতে বড়ো ভূমিকা রাখবে,” বলেন মামুনুর।
তিনি বলেন, “যেসব নারী ও শিশু পর্যটক এই সংরক্ষিত জোন ব্যবহারে আগ্রহী শুধুমাত্র তাঁরা এটি ব্যবহার করবেন। অন্য যেসব নারী ও পুরুষ পর্যটক এই জোনের বাইরে থেকে সৈকত উপভোগ করতে চান সেটা তাঁরা করতে পারবেন।”
“সৈকতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে নারী ও শিশুরা,” জানিয়ে এসময় ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “তাঁদের জন্য আলাদা জোন হলে তাঁরা ঝুঁকিমুক্ত থাকবেন।”
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, নারী ও শিশুর জন্য সংরক্ষিত জোনের উদ্যোগের ফলে নারী পর্যটকরা নির্বিঘ্নে গোসল করতে পারবেন। এ ধরনের উদ্যোগ পর্যটনকে আরও বেগবান করবে।
পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ, ১২০ কিলোমিটার কক্সবাজার প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকতে নারীদের জন্য সংরক্ষিত প্রায় ৬০০ ফুট এলাকায় রাখা হয়েছিল আলাদা ড্রেসিং রুম ও লকার।
এই উদ্যোগ বৈষম্যমূলক
নারী ও শিশু পর্যটকদের জন্য নেয়া কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগকে হাস্যকর ও বৈষম্যমূলক বলছেন নারী অধিকার কর্মী ও নারী পর্যটকেরা।
“এই উদ্যোগ রীতিমতো হাস্যকর। এই ধারণাটি কীভাবে দায়িত্বশীলদের মাথায় আসল তা আমার বোধগম্য নয়,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম।
বিশেষ জোন নয় পুরো এলাকায় নারীদের চলাচল ঝুঁকিমুক্ত করার দাবি জানিয়ে এই নারী নেত্রী বলেন, “হোটেলরুম থেকে শুরু করে সৈকত এবং পুরো কক্সবাজার যেন নারীদের জন্য নিরাপদ বিচরণ উপযোগী হয় সে বিষয়ে প্রশাসনকে নজর দিতে হবে।”
“নারীরা আসলে কোথাও নিরাপদ নয়। নারীদের সঙ্গে থাকা পুরুষরাও কখনো কখনো ঝুঁকিতে পড়ে যান,” মন্তব্য করে মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট এলিনা খান বেনারকে বলেন, “সার্বিকভাবে একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে এ রকম উদ্ভট বিশেষ জোন কোনো কাজে আসবে না।”
“একজন নারী সব সময় তো ওই জোনে অবস্থান করবেন না। তিনি হোটেল রুম থেকে শুরু করে দোকানপাটেও যাবেন, এই ক্ষেত্রগুলো নিরাপদ না হলে এসব ধারণা মোটেও ফলপ্রসূ হবে না,” যোগ করেন এলিনা খান।
শুধু কক্সবাজার নয়, দেশের সবগুলো পর্যটন এলাকার সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টিতে সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে দাবি করে এলিনা বলেন, “নারীদের আবদ্ধ স্থানে নয় বরং অপরাধীদেরকে কারাগারে বন্দি রেখে পর্যটন এলাকাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, পর্যটন খাতের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই সার্বিকভাবে পর্যটন-বান্ধব নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
সম্প্রতি কক্সবাজারে ঘুরে এসেছেন এমন একজন নারী পর্যটক শাহীন আক্তার। তিনি বেনারকে বলেন, “নারীদের জন্য আলাদা জোনের ধারণাটি মোটেও নারী-বান্ধব নয়। এখন দেখা যাবে হয়রানির শিকার নারীরা প্রতিবাদ করলে পুরুষরা বলবে আপনারা নারী জোনে যাচ্ছেন না কেন? এতে করে নারীদের প্রতি হয়রানি আরো বাড়তে পারে।”