অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও পেশাগত স্বাস্থ্য উপেক্ষিত: আইএলও

রিয়াদ হোসেন
2024.01.25
ঢাকা
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও পেশাগত স্বাস্থ্য উপেক্ষিত: আইএলও ঢাকার বাংলা মোটর এলাকায় কোনো প্রকার নিরাপত্তা সামগ্রী ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে বিলবোর্ডের কাজ করছেন কয়েকজন শ্রমিক। ১১ মার্চ ২০২৩।
[মো: হাসান/বেনারনিউজ]

নোয়াখালীর সেনবাগে ২০২২ সালের মার্চ একটি দশতলা ভবন নির্মাণের সময় দুর্ঘটনায় ডান হাত ও পাঁজরের একাংশের হাড় ভেঙ্গে যায় শ্রমিক আব্দুস সোবহানের। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলেও দীর্ঘ চিকিৎসায় তাঁর ছয় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন তিনি আর ভারি কোনো কাজ করতে পারেন না।

আহত হওয়ার পর ভবন মালিকের কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা চিকিৎসা সহায়তা পেয়েছিলেন জানিয়ে লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা সোবহান বেনারকে বলেন, “বাকি টাকা ধার করে চিকিৎসা চালিয়েছি। ওই টাকা এখনো শোধ করতে পারিনি। নিজেও আগের মতো কাজ করতে পারছি না।”

কেবল সোবহান নন, তাঁর মতো নির্মাণ, পরিবহন ও কৃষিখাতের শ্রমিক, গৃহকর্মী, দোকান কর্মী, মৎস্যজীবী, ইটভাটার শ্রমিকসহ লাখ লাখ মানুষের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত। এমনকি আহত বা নিহত হলে তাঁদের অনেকেই ক্ষতিপূরণ পান না। এসব খাতের শ্রমিকদের কোনো মজুরি কাঠামোও নেই।

জেনেভা থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠায় আইএলও।

বাংলাদেশের মোট শ্রম শক্তির ৯৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমখাতে নিয়োজিত বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে।

২০১৩ সালের এপ্রিলে সাভারে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ১১’র বেশি পোশাক শ্রমিক নিহত হন। এর পরে বাংলাদেশের পোশাক খাতে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় “উল্লেখযোগ্য” অগ্রগতি হলেও অপ্রাতিষ্ঠানিকসহ অন্যান্য খাতে শ্রমিকদের “নিরাপত্তা, সহিংসতা ও হয়রানির বিষয়টি এখনো চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে,” বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে।

তবে পোশাক খাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় উন্নতি হলেও কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানির বিষয়টিতে এখনো যেমন চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তেমনি রয়েছে আইনি সীমাবদ্ধতা।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের তথ্য নেই

বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বছরে দুর্ঘটনা কিংবা এতে আহত ও নিহতের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কাছে নেই।

“পরিবহন, কৃষির মতো খাতগুলোতে দুর্ঘটনায় আহত বা নিহতের সংখ্যা আমাদের কাছে নেই। নির্মাণ খাতে কিছু থাকলেও থাকতে পারে,” বেনারকে বলেন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক মো. আকিদ-উল-হাসান।

তবে শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেফটি এন্ড রাইটস ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত বছর সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে পরিবহন খাতে ৩৩৯ জন, যা আগের বছরের তুলনায় ৩৮ শতাংশ বেশি। একই সময়ে সেবা খাতে আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ, নির্মাণ খাতে ২০ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে।

“নিহতের চেয়ে আহত কয়েকগুণ বেশি হবে। তবে আহতের বিশ্বাসযোগ্য সংখ্যা পাওয়া যায় না বলে ওই তথ্য আমরা সংরক্ষণ করি না।,” বেনারকে জানান সেফটি এন্ড রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মো. সেকেন্দার আলী মিনা।

তিনি বলেন, “পোশাক খাতসহ প্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলো যেভাবে তদারক করা হয়, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত সেভাবে তদারকি করা হয় না।”

এর জন্য আইনি দুর্বলতা, কলকারখানা অধিদপ্তরের লোকবল ঘাটতি, মালিকের সক্ষমতার অভাবসহ সার্বিকভাবে তদারকির অভাবকে দায়ী করেন তিনি।

অন্যতম কারণ আইনি দুর্বলতা

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা কিংবা ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার পেছনে আইনি দুর্বলতাকে বড়ো কারণ হিসেবে দেখছেন শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ এডভোকেট জাফরুল হাসান শরিফ। বেনারকে তিনি বলেন, “বিদ্যমান শ্রম আইনের সংজ্ঞায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বিষয়টি উল্লেখ নেই। কিন্তু এটি থাকা উচিত ছিল।”

কেবল শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইনে এ বিষয়ে একটি সংজ্ঞা পাওয়া যায় বলে জানান তিনি।

“শ্রম আইনের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বিষয়টি না থাকায় তাদের মজুরি, কর্মঘণ্টা, ছুটি, অন্যান্য সুবিধা, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কিংবা নিহত-আহতের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ কী হবে, তা নির্ধারণ হয়নি। সেখানে তাঁদের ট্রেড ইউনিয়নও নেই।”

আইএলও’র প্রতিবেদনেও কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার পাশাপাশি সহিংসতা ও হয়রানি রোধে আইনি কাঠামোর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের গঠিত শ্রম আইন সংশোধন বিষয়ক ত্রিপক্ষীয় কমিটির সদস্য চৌধুরী আশিকুল আলম বেনারকে বলেন, “আমরা চেয়েছি যিনি মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন, তাঁকেই শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। কিন্তু আইনে তা করা হয়নি।”

“ফলে বেশিরভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সেভাবে মজুরি বা অন্যান্য সুবিধা বা দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ পান না,” বলেন তিনি।

পোশাক খাতে অগ্রগতি

শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিল্স) তথ্য অনুযায়ী, পোশাক খাতে ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চার বছরে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল দেড় হাজারের বেশি। এর পরের ১০ বছরে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ১৪৮ জনে।

এর মধ্যে গত দুই বছরে কোনো মৃত্যু ছিল না। গত বছর আহত হয়েছিলেন ১৩৪ জন শ্রমিক। পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ধীরে ধীরে এ খাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী তীব্র সমালোচনার মুখে এ খাতে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ, ভবনের কাঠামো ঠিকঠাক করা ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তায় সরকার মনযোগী হওয়ায় এ অগ্রগতি হয়েছে। এক্ষেত্রে ইউরোপ ও আমেরিকাভিত্তিক ক্রেতাদের দুটি জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স এর তদারকি বড়ো ভূমিকা রেখেছে। 

শ্রমিক নেতা তৌহিদুর রহমান বেনারকে বলেন, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে শ্রমিকের নিরাপত্তায় কাজ শুরু করার পর থেকেই এই খাতে অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়েছে।

বাংলাদেশ অ্যাপারেল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের এই সভাপতি বলেন, “পোশাক খাতের বাইরে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতসহ অন্যান্য খাতে একই ধরনের তদারকি হলে সেখানেও ‍দুর্ঘটনা ও মৃত্যু ঝুঁকি কমে আসবে।”

ন্যুনতম মজুরির আওতায় আনার উদ্যোগ

শ্রম মন্ত্রণালয় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরিসহ অন্যান্য সুবিধায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে।

এ লক্ষ্যে শ্রম মন্ত্রণালয় জাতীয় মজুরি নীতিমালা করতে যাচ্ছে বলে বেনারকে জানান চৌধুরী আশিকুল আলম। তিনি নিজেও এই নীতিমালারে লক্ষ্যে গঠিত কমিটির সদস্য।

আশিকুল আলম বলেন, “এই কমিটি একটি খসড়া তৈরির কাজ করছে। খসড়া তৈরি হলে তা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মতামতের জন্য পাঠানো হবে। এর পর নীতিমালা প্রকাশ করা হবে।”

এই নীতিমালা চূড়ান্ত হলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা প্রাতিষ্ঠানিক ৪৩টি খাতের মত ন্যুনতম মজুরি, ছুটি, দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণসহ অন্যান্য সুবিধার আওতায় আসবে।”

নীতিমালার কাজ চলমান রয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।