ড. ইউনূসের পক্ষে কথা বলায় চাকরি হারাচ্ছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
2023.09.05
ঢাকা

ড. ইউনূসকে বিচারের মাধ্যমে হয়রানি করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে চাকুরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘সম্মানিত ব্যক্তি’ এবং তিনি ‘বিচারিক হয়রানির’ শিকার হচ্ছেন বলে সোমবার সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া।
এই মন্তব্যের পরদিন মঙ্গলবার তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঢাকায় সাংবাদিকদের জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে হলে হয় তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে অথবা অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, “তিনি তা করেননি। তিনি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন।”
ইউনূসকে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘হয়রানি’ করা হচ্ছে এবং এই ‘হয়রানি’ বন্ধ করতে তাঁর বিরুদ্ধে সকল আইনি প্রক্রিয়া বন্ধের জন্য শেখ হাসিনার প্রতি গত ২৮ আগস্ট আহ্বান জানিয়ে শতাধিক নোবেল বিজয়ী এবং বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিরা খোলা চিঠি দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সপ্তাহে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বঞ্চিত শ্রমিকেরা মামলা করেছেন। সরকার কোনো মামলা করেনি এবং সাংবিধানিকভাবে কোনো মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা তাঁর নেই।
এদিকে ড. ইউনূসের পক্ষে বিশ্ব নেতাদের বিবৃতিকে দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশের ৫০ জন সম্পাদক এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের একটি অংশ বিশ্ব নেতাদের বিবৃতিকে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করে এর নিন্দা জানিয়ে পাল্টা বিবৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নেন। সেখানে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান।
সোমবার এমরান সাংবাদিকদের বলেন, ড. ইউনূস সম্মানিত ব্যক্তি। তাঁকে বিচারের নামে হয়রানি করা হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন এবং সে কারণে তিনি এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করবেন না।
আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মঙ্গলবার বলেন, “ইনসাবর্ডিনেশন ও ইনডিসিপ্লিনের কারণে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল বেনারকে বলেন, “ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিবাদ ও বক্তব্যের ঘটনা প্রমাণ করেছে যে, আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং অন্যান্য সংস্থাকে ব্যাপকভাবে দলীয়করণ করেছে।”
“কিছু লোক সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পদের লোভে নাচছে, আবার কিছু লোক চাপের মুখে তা করছে,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
হয়রানি ও ভয়ভীতির সম্মুখীন হচ্ছেন ইউনূস: ওএইচসিএইচআর
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) অভিযোগ করেছে যে, বাংলাদেশে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, মানবাধিকারকর্মী এবং সুশীল সমাজের নেতাদের ক্রমাগত ভয়ভীতি ও হয়রানি করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার জেনেভা থেকে ওএইচসিএইচআরের হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণ ও সুরক্ষায় মানবাধিকারকর্মী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কাজের প্রয়োজনীয় নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
এতে বলা হয়, ড. ইউনূস প্রায় এক দশক ধরে হয়রানি ও ভয়ভীতির সম্মুখীন হচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি শ্রম আইন লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগে দুটি মামলার বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন, রায়ে তাঁর কারাদণ্ড হওয়ার আশঙ্কা আছে।
ইউনূসের মামলার শুনানি
এদিকে মঙ্গলবার অন্য মামলায় ড. ইউনূসকে ফাঁসাতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর আদালতে জাল কাগজপত্র দাখিল করেছে বলে অভিযোগ করেন তাঁর আইনজীবী।
গ্রামীণ টেলিকমে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় সাক্ষী জেরাকালে তৃতীয় শ্রম আদালতে এই অভিযোগ করেন ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন।
এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ উল্লেখ করে এই অপরাধের জন্য কলকারখানা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকসহ এই মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পরিদর্শকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার দাবি জানান আব্দুল্লাহ আল মামুন।
আদালত আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর পুনরায় এই মামলার শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন তিনি।
ড. ইউনূস এবং অভিযুক্ত গ্রামীণ টেলিকমের আরও তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের যেসব কাগজপত্র বিবাদী পক্ষকে কলকারখানা অধিদপ্তর সরবরাহ করেছে সেগুলোর সঙ্গে আদালতে দেওয়া কাগজপত্রের মধ্যে অমিল রয়েছে বলে সাক্ষ্য প্রক্রিয়ায় বের করেন ড. ইউনূসের আইনজীবী।
তিনি বলেন, “কলকারখানা অধিদপ্তর চেকলিস্ট জালিয়াতি করে আদালতে দাখিল করেছে যা একটি ফৌজদারি অপরাধ। …ড. ইউনূসকে এই মামলায় জড়ানোর জন্যই এটা করা হয়েছে।”
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “এই অপরাধের দায়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক, অন্যান্য পরিদর্শক ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার আবেদন জানাচ্ছি। তাঁদের এই আদালতে হাজির করা হোক।”
জালিয়াতির অভিযোগের ব্যাপারে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বেনারকে বলেন, “কোনো জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি।”
তিনি বলেন, “তাঁদেরকে (গ্রামীণ টেলিকম) কলকারখানা অধিদপ্তর যে চেকলিস্ট দিয়েছে সেটি পরিদর্শন শেষ হওয়ার আগেই তৈরি করা হয়েছে।”
তৈরির আগেই কেন অসম্পূর্ণ কাগজ দেওয়া হলো এমন প্রশ্নের জবাবে খুরশীদ আলম বলেন, “অধিদপ্তর সরল বিশ্বাসে সেটা দিয়েছে।”
তাঁর দাবি নাকচ করে আব্দুল্লাহ আল মামুন বেনারকে বলেন, “তাঁরা কেন আমাদের অসম্পূর্ণ কাগজপত্র দেবে আর আদালতে আরেকটি দাখিল করবে? এটি জালিয়াতি ছাড়া আর কিছু না।”