জাতিসংঘে ড. ইউনূসের ভাষণে গুরুত্ব পাবে বাংলাদেশ পুনর্গঠন
2024.09.20
ঢাকা
আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪। ইস্টার্ন সময় বিকাল ৩.৫৩।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর প্রথম বিদেশ সফরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বিশ্ব নেতাদের সহায়তা চাইবেন।
সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার সরকার পতনের প্রেক্ষাপট ও ঘটনাবলী তুলে ধরবেন।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
গত সপ্তাহে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অর্থনীতি একটা বিশৃঙ্খল, ভঙ্গুর অর্থনীতি হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে মানুষ এত বিক্ষুব্ধ। এটা লুটের সরকার ছিল।”
সেই লুটের সরকার থেকে সত্যিকার সরকার ও জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করাই মানুষের আকাঙ্ক্ষা, যা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তিনি নতুন বাংলাদেশ গড়তে চান বলে উল্লেখ করেন।
এর গত ১৮ আগস্ট প্রথমবারের মতো বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমি দেশের দায়িত্ব নিয়েছি, তবে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে।”
“বিচার বিভাগ ভেঙে পড়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে, পাতানো নির্বাচন করা হয়েছে। ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে তরুণ সমাজ বেড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংক ডাকাতি হয়েছে।”
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার এখন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন এবং ভঙ্গুর অর্থনীতির উদ্ধারে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আশা করি প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে তাঁর বক্তৃতায় এবং বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এ সব বিষয়ে সহযোগিতা চাইবেন।”
এদিকে স্মরণকালের সবচেয়ে ছোট প্রতিনিধি দল নিয়ে ড. ইউনূস ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। ২৭ সেপ্টেম্বর সেখানে জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন তিনি।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এবং একই সঙ্গে সরকার প্রধান হিসেবে প্রফেসর ইউনূসের এই সফর দেশে এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।
শান্তিতে নোবেলজয়ী হিসেবে অথবা নিজের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় বহুবার কথা বলেছেন বিশ্ববরেণ্য এই বাংলাদেশি।
তবে এবার তিনি সেখানে যাচ্ছেন নতুন এক পরিচয়ে। তিনি এখন বাংলাদেশর সরকার প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ৮ আগস্ট তাঁর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়।
প্রয়োজনীয় কর্মকর্তারাই যাচ্ছেন
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের এই সফরে সব মিলিয়ে অন্তত ২৫ জন কর্মকর্তা নিউইয়র্কে যাচ্ছেন। তবে তাঁর মূল সফরসঙ্গী হচ্ছেন মাত্র সাত জন। বাকিদের মধ্যে রয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ আরো কয়েকজন উপদেষ্টা এবং নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত দল ও জনসংযোগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বেনারকে নিশ্চিত করেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য মতে, প্রধান উপদেষ্টার মূল সফরসঙ্গী সাত জন হলেন- তাঁর মেয়ে দিনা আফরোজ ইউনূস, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল আলম, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম, একান্ত সচিব শাব্বীর আহমদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা তিথি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা একটি সুবিন্যস্ত প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন যেখানে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করবেন।”
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বেনারকে বলেন, “এই বিষয়টি আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক। আগে কী হয়েছে তা আমাদের বিষয় নয়। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সফরসঙ্গী তাঁরাই হচ্ছেন যারা প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয়।”
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ২০১৫ সালে ২২৭ জনের একটি দল নিয়ে নিউইয়র্কে ৭০তম সাধারণ অধিবেশন এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যান। ২০১৪ সালে ৬৯তম সাধারণ অধিবেশনে এ সংখ্যা ছিল ১৭৮, আর ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৩৪ জন।
সাইডলাইনে হবে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা ও সরকারের অন্যান্য পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
সরকারের একাধিক কর্মকর্তা বেনারকে জানিয়েছেন, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকগুলো কার কার সঙ্গে হতে পারে তা শুক্রবার বিকেল পর্যন্তও চূড়ান্ত হয়নি।
“আমাদের সরকার দায়িত্ব নেয়ার মাত্র এক মাসের মাথায় এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে। সেখানে নানা প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। এই প্রস্তুতিগুলো নানা পর্যায়ে চলছে। সাইডলাইনে কোন কোন দেশের সঙ্গে বা কোন কোন সংস্থার সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হতে পারে সেই বিষয়গুলো নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়,” বেনারকে বলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
প্রধান উপদেষ্টার এই সফর সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শনিবার একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বেনারকে জানান, এই সফরে একাধিক দেশের সরকার প্রধানদের সঙ্গে ড. ইউনূসের সাইডলাইন বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একটি বৈঠকের চেষ্টা করা হলেও সেটির সম্ভাবনা এখন কম জানান এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “দুই সরকার প্রধানের সফরের সময় অনেকটা আলাদা…এ কারণে এই বৈঠকটি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।”
এদিকে, বৃহস্পতিবার ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক হিন্দুস্থান টাইমসের এক খবরে কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে তা দূর করতেই দুই নেতার বৈঠকে আগ্রহী বাংলাদেশ।
“তবে এ ধরনের বৈঠক ভারতের এজেন্ডায় নেই,” বলে জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে।
এসব বৈঠক সম্পর্কে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট কূটনৈতিক এম হুমায়ুন কবির বেনারকে বলেন, “ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক হলে সেটা খুবই ভালো ব্যাপার হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের যেসব দেশের সঙ্গে স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে যেমন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন ও জাপান-- এসব দেশের সঙ্গে বৈঠক করতে পারলে সেগুলো খুব কাজে দেবে।”
ভাষণে গুরুত্ব পাবে ছাত্র-জনতার আন্দোলন, বাংলাদেশ পুনর্গঠন
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রফেসর ইউনূসের ভাষণে কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব পেতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, “ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানের বিষয়টি ব্যাপকভাবে গুরুত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সংস্কার বা দেশ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ার বিষয়গুলো উঠে আসতে পারে।”
কূটনৈতিক হুমায়ুন কবির বলেন, “খুব স্বাভাবিক কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যুটি আলোচনায় আসতে পারে। কারণ, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য এমন একটি সমস্যা যেটি সমাধানে সবগুলো দেশের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।“
গত মাসের শেষ দিকে এক ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রফেসর ইউনূসের উপস্থিতি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কৌশলগুলোকে তুলে ধরার একটি উল্লেখযোগ্য সুযোগ।
উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের এই পরিচালক বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এটিই তাঁর (ইউনূসের) প্রথম বড়ো আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কর্মসূচি। এখানে তিনি দেশ শাসনে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার পাশাপাশি, সরকার যে সংস্কারগুলি করতে চায় তার রূপরেখা তুলে ধরতে পারবেন।”
গত বেশ কয়েক বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রফেসর ইউনূস কোন ভাষায় ভাষণ দিবেন এমন প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, “এটা তাঁর ইচ্ছা। উনি দুই ভাষাতেই সমানভাবে পারদর্শী।”
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশন ১০ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে। উচ্চ স্তরের সাধারণ বিতর্কের প্রথম দিন ২৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে।
( সংশোধনী: এই সংবাদের পূর্ববর্তী সংস্করণে ভুলভাবে বলা হয়েছে যে, ইউনূসই একমাত্র নোবেল বিজয়ী যিনি বর্তমানে একটি দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সঠিক তথ্য অনুসারে, ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আরেকজন নোবেল বিজয়ী যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। )