অধ্যাপক জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা মামলায় মাদ্রাসাছাত্রের যাবজ্জীবন
2022.04.26
ঢাকা

চার বছর আগে বিশিষ্ট লেখক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টার দায়ে হামলাকারীকে যাবজ্জীবন এবং তাঁর এক সহযোগীকে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। এ মামলায় খালাস পেয়েছে চারজন।
মঙ্গলবার সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লব এ রায় ঘোষণা করেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) মমিনুর রহমান টিটু। রায় ঘোষণাকালে আসামিরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
টিটু জানান, এই মামলার প্রধান আসামি ফয়জুল হাসান (২৮) যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছেন আর আক্রমণ পরিকল্পনায় সহায়তা করার অভিযোগে চার বছরের কারাদণ্ড পেয়েছেন তাঁর বন্ধু সোহাগ মিয়া।
মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন ফয়জুলের বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফজলুল হক ও ভাই এনামুল হাসান।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি ফয়জুলকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং সোহাগ মিয়াকে চার বছরের কারাদণ্ড ছাড়াও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে জানান টিটু।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে একটি অনুষ্ঠান চলাকালে ২০১৮ সালের ৩ মার্চ বিকেলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালান মাদ্রাসাছাত্র ফয়জুল হাসান। একটি ছুরি দিয়ে জাফর ইকবালের মাথা ও ঘাড়ে উপুর্যপরি আঘাত করেন ফয়জুল।
ঘটনাস্থল থেকেই ফয়জুলকে হাতেহাতে ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছাত্র-শিক্ষকরা। এ ঘটনায় ওই দিন রাতেই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জালালাবাদ থানায় মামলা করেন।
২০১৮ সালের ২৬ জুলাই হামলাকারী ফয়জুল ও তার বাবা-মা, ভাইসহ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। একই বছরের ৪ অক্টোবর মামলার অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে আলোচিত এই মামলার বিচারকাজ শুরু হয়।
রায়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের কাছে সন্তোষ প্রকাশ করেন মামলার বাদী মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন।
তবে “দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা ন্যায় বিচার পাননি,” জানিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী মোতাহির আলী বেনারকে বলেন, তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।
আইনজীবীরা জানান, এই মামলার ৫৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে আদালত।
যারা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে, তাদের ওপর রাগ জাফর ইকবালের
হামলাকারীর ওপর ব্যক্তিগতভাবে কোনো রাগ নেই বলে জানালেও ফয়জুলকে যে বা যারা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেছেন, রায়ের পর তাঁদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন হামলার শিকার বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জাফর ইকবাল।
“যে মানুষগুলো বা যে সিস্টেম তাদের রেডিকেলাস (মৌলবাদী) করে, জঙ্গি তৈরি করে দেয় যে, আমাকে বা আমার মতো অন্য আরেকজনকে মারলে তারা বেহেশতে যাবে, সেই মানুষগুলোর ওপর আমার ক্ষোভ আছে,” ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন জাফর ইকবাল।
তিনি বলেন, “তাঁদের চিহ্নিত করতে পারলে আমার আনন্দ হতো। তাঁদের তৎপরতা বন্ধ করতে পারলে আমি শান্তি পেতাম।”
এই হত্যাচেষ্টা ‘ধর্মীয় সন্ত্রাস’
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা মামলার রায়ে দেওয়া পাঁচ পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, “ইসলাম ধর্মের প্রকৃত মর্মবাণীকে না বুঝে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করাকে পুণ্যের কাজ মনে করে আসামি এই বর্বর হামলা চালিয়েছে। তার এমন কাজ নিঃসন্দেহে একটি সন্ত্রাসী কাজ। আরও সুস্পষ্টভাবে বললে ধর্মীয় সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু নয়।”
আদালত জানায়, জাফর ইকবাল বিজ্ঞান বিষয়ে ও শিশুদের উপযোগী বই লিখে “জাতির মননশীলতা গঠনে ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীলতার পক্ষে তার সরব অবস্থান সর্বজনবিদিত।”
যে সব লেখক মুক্তবুদ্ধি, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞান, সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কারের বিষয়ে লেখেন বা বক্তব্য রাখেন তাঁদের মধ্যে “ভীতি, শঙ্কা ছড়িয়ে দেওয়াই” হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল বলে জানানো হয় পর্যবেক্ষণে।
“স্বাধীন মত প্রকাশ, পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্র, প্রগতিশীলতা তথা সভ্যতার অগ্রগতির প্রধান নির্ণায়ক,” মন্তব্য করে পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “এগুলোর চর্চা নিশ্চিত করা না গেলে দেশ নিশ্চিতভাবেই পেছনের দিকে হাঁটবে।”
আসামি ফয়জুল হাসান দেশ বা কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য—এমনটা প্রমাণিত হয়নি জানিয়ে বিচারক বলেন, “তিনি বিভিন্ন ইন্টারনেট সাইট থেকে জিহাদি প্রবন্ধ ও বই ডাউনলোড করে পড়ে, উগ্রবাদী বক্তাদের বক্তব্য শুনে সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ হন।”
কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কৌশলে ভার্চুয়াল জগতে উগ্রবাদী মতবাদ ছড়িয়ে “সহজে বেহেশতে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে” তরুণদের সন্ত্রাসবাদে উৎসাহিত করছে জানিয়ে বিচারক বলেন, “উচ্চশিক্ষিত ও প্রযুক্তিতে দক্ষ তরুণেরা সহজেই তাঁদের পাতানো ফাঁদে পা দিচ্ছেন।”
উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে মদদ দেয়, এমন বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের তথ্যের প্রবাহ বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলেন আদালত।