সন্তান হত্যার বিচার না দেখেই চলে গেলেন অজয় রায়

জেসমিন পাপড়ি
2019.12.09
ঢাকা
191209_Ajoy_Roy_passed_away_620.jpeg ছেলে অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিতে অসুস্থ অধ্যাপক অজয় রায়কে চেয়ারে বসিয়ে ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী আদালতে হাজির করা হয়। ২৮ অক্টোবর ২০১৯।
[নিউজরুম ফটো]

সন্তান হত্যার বিচার না দেখেই চলে গেলেন জঙ্গি হামলায় নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বাবা পদার্থ বিজ্ঞানে একুশে পদকজয়ী অধ্যাপক ড. অজয় রায় (৮৪)।

সোমবার দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটের দিকে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন তাঁর ছোট ছেলে অনুজিৎ রায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা, মুক্তিযোদ্ধা অজয় রায় ফুসফুসের সংক্রমণের পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। শাররিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত ২৫ নভেম্বর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ছেলে জঙ্গি হামলায় নিহত হওয়ার পর ভেঙে গিয়েছিলেন, সেই শোক সইতে না পেরে স্ত্রীও গত হয়েছিলেন বছরখানেক আগে। শুরুতে অস্বীকৃতি জানালেও মৃত্যুর মাত্র মাস খানেক আগে তিনি ছেলে অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেন।

বিচার দেখে যেতে না পারা দুঃখজনক

সন্তান হারানোর প্রায় পাঁচ বছরেও বিচার না পাওয়ার শোক নিয়ে তাঁর এই চলে যাওয়া দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনেরা। তাছাড়া অভিজিৎ হত্যার বিচারের জন্য বারবার তাঁকে আদালতে টানাহেঁচড়া করা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁরা।

অজয় রায়ের মৃত্যুর খবর শুনে বারডেম জেনারেল হাসপাতালে ছুটে যান একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। সেখানে আলাপকালে বেনারনিউজকে তিনি বলেন, ‘বিলম্বের কারণে ছেলে অভিজিৎ রায়ের হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেননি বাবা অজয় রায়। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।’

তিনি বলেন, “অজয় রায়ের জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল ছেলে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড। ২০১৫ সালের ওই ঘটনার শোক তিনি সামলাতে পারেননি। তারপর থেকেই তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে।”

“তাছাড়া ছেলে হত্যার বিচারের জন্য বারবার তাঁকে যেভাবে আদালতের হাজিরা দিতে হয়েছে, এটা প্রত্যাশিত ছিল না। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। ব্লগারদের হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত বিচার আদালতে সম্পন্ন করতে বারবার দাবি জানানো হলেও তা হয়নি,” বলছিলেন বিভিন্ন আন্দোলনে অজয় রায়ের এই সহযোদ্ধা।

অভিজিৎ রায়ের ছোট ভাই অনুজিৎ রায় বেনারকে বলেন, “আমার বড় ভাই অভিজিৎ রায়ের বিচার নিয়ে এত বছরে এত কথা হয়েছে, সেটা নিয়ে নতুন করে আর বলার কিছু নেই। বাবকে হারিয়ে এখন সেই মানসিকতাও আমাদের নেই।”

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বেনারকে বলেন, “ধীমান ব্যক্তিত্ব অজয় রায় আমাদের জন্য পথ তৈরি করেছিলেন। তাঁর অকাল প্রস্থান আমাদের আগামী দিনগুলোকে সংকটাপন্ন করে তুলবে।”

তাঁর বিশ্বাসে অবিচল থাকায় সন্তান অভিজিৎ রায়কে নির্মম হত্যার শিকার হতে হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য আমেরিকা থেকে সস্ত্রীক ঢাকায় আসেন অভিজিৎ রায়। মেলা শেষ হওয়ার মাত্র দুদিন আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরের কাছে তাঁকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করে জঙ্গিরা। চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই হামলায় স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা হাতের দুটি আঙুল হারান।

তদন্ত শেষে এ বছরের ১৩ মার্চ আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান ও সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এরপর গত ১ আগস্ট এ মামলায় অভিযোগ গঠন করে আদালত।

ছেলে হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি

অভিজিৎ হত্যা মামলায় অভিযোগ গঠনের পর তিনবার সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ হয়। কিন্তু মামলার বাদী অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ের অনুপস্থিতির কারণে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি।

সে সময় অজয় রায় বেনারকে বলেন, “আমি বিচার চাই। কিন্তু আদালতে সাক্ষ্য দিতে যেতে চাই না। আমার বয়স হয়েছে। ‍নিহত পুত্রের বিচার প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করা আমার জন্য খুবই বেদনাদায়ক হবে। শোকবিহ্বল পিতা হিসেবে বিচার প্রক্রিয়ার এই দৃশ্য সহ্য করতে পারব না।”

তিনি লিখিতভাবে তাঁর বক্তব্য আদালতকে জানাতে চেয়েছিলেন। তবে গাফিলতির কারণে সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রীয় কৌঁসুলি জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে সরিয়ে দেয়ার পর গত ২৮ অক্টোবর ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে আদালতে সাক্ষ্য দেন অধ্যাপক অজয় রায়।

সেদিন অসুস্থ অধ্যাপক অজয় রায়কে চেয়ারে বসিয়ে সন্ত্রাস বিরোধী আদালতে হাজির করা হয়।

হাসপাতালে দেহদান

অজয় রায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাজে তাঁর মরদেহ দান করা হবে বলে জানান তাঁর ছোট ছেলে অনুজিৎ রায়।

তবে তার আগে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য তাঁর মরদেহ মঙ্গলবার সকালে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

অনুজিৎ বেনারনিউজকে বলেন, “বাবার ইচ্ছা ছিল তাঁর মরদেহ কোনো মেডিকেলে দান করার। তাঁর সেই ইচ্ছা অনুযায়ী আমরা বাবার দেহ বারডেম হাসপাতালে দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

এর আগে গত ৩ জানুয়ারি অজয় রায়ের স্ত্রী শেফালী রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ ঢাকার আদ-দ্বীন হাসপাতালে দান করা হয়। জঙ্গি হামলায় নিহত তাঁদের সন্তান ব্লগার ও বিজ্ঞান মনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়ের মরদেহও চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দান করা হয়েছিল।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক

অজয় রায়ের জন্ম দিনাজপুরে ১৯৩৫ সালের ১ মার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে এমএসসি পাশ করে যোগ দিয়েছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে সেখানেই করেন পোস্ট ডক্টরেট। ২০০০ সালে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী নৃশংস গণহত্যা শুরু করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। ২৪ মে তিনি সীমান্তবর্তী সোনামুড়া সীমান্তে পৌঁছান, সেখানে রিক্রুটিং সেন্টারে কাজ করেন। জুন মাসের মাঝামাঝি তিনি আগরতলা হয়ে কলকাতায় যান। সেখানে কাজ করেন মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের সান্মানিক সদস্য হিসেবে।
অজয় রায় ছিলেন প্রগিতশীল চিন্তার পথিকৃৎ। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক, সম্প্রীতি মঞ্চের সভাপতি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের সহ–সভাপতি এবং এশিয়াটিক সোসাইটির বিজ্ঞান বিভাগের সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি এবং দক্ষিণ এশীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। ছিলেন মুক্তমনার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং মুক্তান্বেষার সম্পাদক।

অজয় রায় ২০১১ সালে বাংলা একোডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ২০১২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে একুশে পদক অর্জন করেন।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও একুশে পদক বিজয়ী অধ্যাপক অজয় রায়ের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি, মুক্তিযোদ্ধা অজয় রায়ের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তাঁর শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, অজয় রায় আমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে কাজ করে গেছেন। একজন শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন অনুকরণীয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক শোকবার্তায় প্রয়াতের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।