‘সামহোয়্যার ইন ব্লগ’ খুলে দেওয়া হলেও বন্ধের কারণ অজানা
2019.10.25
ঢাকা
বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় অনলাইন কমিউনিটি প্ল্যাটফর্ম ‘সামহোয়্যার ইন ব্লগ’ আবার চালু হয়েছে। প্রায় আট মাস বন্ধ রাখার পর মঙ্গলবার রাতে এটি খুলে দিয়েছে সরকার।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বিষয়টি নিশ্চিত করে বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, “আপনি হয়তো জানেন না টিকটক, বিগো, সামহোয়্যার ইন ব্লগ এখন আর ‘ব্লক’ করা নয়।”
নরওয়ে থেকে সামহোয়্যার ইন ব্লগের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দা গুলশান ফেরদৌস জানা শুক্রবার বেনারকে বলেন, “যেভাবে কিছু না জানিয়ে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, সেভাবে কিছু না জানিয়েই ব্লগটি খুলে দেওয়া হয়েছে।”
এর আগে ব্লগটি বন্ধের কারণ জানতে চাইলে মোস্তাফা জব্বার বেনারকে বলেছিলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতামতের ভিত্তিতে ব্লগটি বন্ধ আছে।”
তবে গুলশান ফেরদৌসের অভিযোগ অন্য রকম।
“তিনি (মন্ত্রী) অভ্রকে নিয়ে যা করেছিলেন, সেটার বিরুদ্ধে সামহোয়্যারইন সোচ্চার ছিল। ব্লগাররা ওনাকে ভীষণ সমালোচনা করেছিলেন,” বলেন সৈয়দা গুলশান ফেরদৌস জানা।
“এটা সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সিদ্ধান্ত—তা আমি মানিনা। তাদের মাথা খারাপ হয়নি যে মাতৃভাষা চর্চার একটি সাইটকে পর্ণোগ্রাফি বা জুয়ার সাইট বলবে,” বলেন তিনি।
এর আগে বৃহস্পতিবার মন্ত্রী বেনারকে বলেন, “আমি কোনো ব্যবস্থা নিলে সরাসরি বলে দিতাম, ওইটুকু সৎ সাহস আমার আছে।”
যদিও ব্লগটি বাংলাদেশে বন্ধ হওয়ার পর গত ফেব্রুয়ারিতে ডয়েচে ভেলেকে মন্ত্রী বলেছিলেন, “সামহোয়্যার ইন ব্লগ একসময় খুবই বিতর্কিত ছিল। এদের কনটেন্টগুলো ছিল সরকারবিরোধী।”
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) মুখপাত্র ও সিনিয়র সহকারি পরিচালক মো. জাকির হোসেন খান শুক্রবার বেনারকে জানান, তিনিও মন্ত্রীর ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে সামহোয়্যার ইন ব্লগটি মুক্ত হওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন।
“ঠিক কী কারণে এটা বন্ধ করা হয়েছিল, আর কেন খুলে দেওয়া হলো—এটা আমার জানা নেই,” বলেন এই কর্মকর্তা।
পরস্পরবিরোধী বক্তব্য
“যাদের ব্লগ বন্ধ হয়েছে, তারা বন্ধের কারণ জানতে চায়নি, আবেদনও করেনি। খোলার কথাও বলেনি,” সামহোয়্যার ইনের ব্লগ ‘ব্লক’ করা প্রসঙ্গে বেনারকে বলছিলেন মন্ত্রী।
যদিও গুলশান ফেরদৗস দাবি করেন, সামহোয়্যার ইন ব্লগ কর্তৃপক্ষ বারবার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পায়নি।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এবং পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীকে মেইল করেছেন ব্লগ সংশ্লিষ্টরা। আর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যানকে বারবার ইমেইল করে বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়।
দেশে এসে মন্ত্রীর সাথে দেখা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ার কথা জানান গুলশান ফেরদৌস।
তবে মন্ত্রী বেনারকে বলেন, “আমার কাছে সবার ‘এক্সেস’ আছে। যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন।”
সর্বশেষ গত ১৯ অক্টোবর মন্ত্রীকে সংযুক্ত করে ফেসবুকে একটি লেখা প্রকাশ করেন গুলশান ফেরদৌস জানা। এর কিছুক্ষণের মধ্যে নিজের টাইমলাইন থেকে লেখাটি মুছে ফেলে মন্ত্রী তাঁকে ফেসবুকে ‘ব্লক’ করেন।
এরপরই মঙ্গলবার রাতে বিভিন্ন ব্লগার এবং গুগুল এ্যানালিটিক্সের বার্তা পেয়ে জানা বুঝতে পারেন যে, অবরোধ তুলে নেওয়া হয়েছে।
অশ্লীলতা ও জুয়ার ওয়েবসাইট বন্ধে ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে বা আইআইজিগুলোকে ১৭ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসি একটি তালিকা পাঠায়। সেই তালিকাতেই সামহোয়্যার ইন ব্লগের নাম দেওয়া হয়েছিল।
তবে এই ব্লগের লেখা অশ্লীলতা বা জুয়ার সঙ্গে যুক্ত—এমন কোনও তথ্য প্রকাশ করেনি ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। বিটিআরসির সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. জাকির হোসেন খান বেনারকে বলেন, “নির্দেশ পেলে আমরা কারিগরি ব্যবস্থা নিই।”
কাদের নির্দেশে কারিগরি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা জানতে চাইলে জাকির বলেন, “মন্ত্রী, সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে নির্দেশনা আসে।”
যে ক্ষতিটা অপূরনীয়
‘নাস্তিক, জামাতি, বামাতি, আওয়ামী বা জাতীয়তাবাদী দালাল’—এসব আখ্যা পেয়েছে সামহোয়্যার ইন কর্তৃপক্ষ। যে কারণে প্রচুর পাঠক থাকা সত্ত্বেও দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন পায় না ব্লগটি।
“তার উপরে বন্ধ থাকার কারণে গুগল থেকে যে আয় হতো, সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে আমাদের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে,” বলেন ব্লগটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
“তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হচ্ছে, মর্যাদাহানী। ব্লগটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমার বা আমার স্বামীর শুধু নয়, প্রায় আড়াই লক্ষ ব্লগারের চূড়ান্ত মর্যাদাহানী হয়েছে। তাদের ‘পর্ণো রাইটার’ বলা হয়েছে,” যোগ করেন জানা।
এ ঘটনায় সারা বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে ছোট করা হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। জানা বলেন, “ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য এই দৃষ্টান্ত লজ্জার। তবুও ব্লগটি খুলে দেওয়ায় আমি মন্ত্রীকে অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ জানাতে চাই।”
সামহোয়্যার ইন ব্লগের যাত্রা শুরু ২০০৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। মূলত বাংলাদেশে অনলাইন অ্যাকটিভিজমের শুরু হয় এখান থেকে। প্রতিদিন ব্লগটির লেখা পড়তের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ। এখানে যাঁরা লিখতেন ও পড়তেন তাঁদের প্রায় সবাই মত প্রকাশে স্বাধীনতার পক্ষে।