বুয়েট শিক্ষার্থীদের অভিযোগ জানানোর ওয়েবপেইজটি বন্ধ করলো সরকার

প্রাপ্তি রহমান ও জেসমিন পাপড়ি
2019.10.10
ঢাকা
বুয়েট শিক্ষার্থীদের অভিযোগ জানানোর  ওয়েবপেইজটি বন্ধ করলো সরকার আবরার হত্যা নিয়ে শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সমাবেশ। ঢাকা।অক্টোবর ৯, ২০১৯।
ছবি: বেনার নিউজ।

র‍্যাগিং ও নির্যাতনের বিভিন্ন অভিযোগ জানাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থীদের চালু করা একটি ওয়েবপেজ বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের—বিটিআরসি।

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন বিটিআরসির চেয়ারম্যান মো. জহুরুল হক। তিনি বেনারকে বলেন, “চলমান পরিস্থিতিতে পেজটি নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। সে কারণে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”

বুয়েট শিক্ষার্থীদের এই ওয়েবপেজে বুধবার পর্যন্ত গত আড়াই বছরে ১০৩টি অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রশাসনকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানান ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা।

বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান মোস্তফা আকবর বলেন, তাঁরা জানতে পেরেছেন বিটিআরসি পেজটি বন্ধ করে দিয়েছে।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীরা যেন যেকোনো অসুবিধার কথা জানাতে পারে সে জন্য সাত-আট মাস আগে পেজটি আমরা চালু করেছিলাম।”

“বিটিআরসির বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা আছে। তারা বন্ধ করে দিয়েছে। এখানে আমাদের আসলে কিছু করার সুযোগ নেই," মোস্তফা আকবর বলেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে মত প্রকাশের কারণে আবরার ফাহাদ নিহত হলো, সেই মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করা হলো এই পেজটি বন্ধ করার মধ্য দিয়ে। এই পেজের মধ্য দিয়ে বুয়েটের আবাসিক হলে ছাত্রদের কি অবস্থা সেটা বেরিয়ে এসেছিল। এর ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নিয়ে বন্ধ করে দেওয়া ঠিক হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান বেনারকে বলেন, “ঠিক কোন বিবেচনায় বিটিআরসি পেজ বন্ধ করে দিলো তা কোনভাবেই বোধগম্য হচ্ছে না। যেসব শিক্ষার্থীরা এত দিন মুখ খুলতে পারেননি তারা হয়তো এখন অনেক কিছুই জানাতেন। সেই সুযোগ থাকল না।”

তাঁর মতে, “এটা মত প্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন করার সামিল। এর অর্থ হলো শিক্ষার্থীদের অভিযোগকে তোয়াক্কা না করা। ব্যাপারটা দুঃখজনক।”

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ  গোলাম রহমান বলেন, “প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্ছৃঙ্খলতা ও ‘মাস্তানিতে’ জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না। অথচ বিটিআরসি প্রধানমন্ত্রীর সে নির্দেশনার বিরুদ্ধে কাজ করলো।”

নাম না প্রকাশ করার শর্তে বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী বেনারকে বলেন, “এই পেজটি বন্ধ করে দিয়ে বিটিআরসি একটি অপরাধ করলো।”

২০১৬ সালের শেষ দিকে বুয়েটের সিএসই বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীর গড়ে তোলা এই ওয়ানস্টপ অনলাইন রিপোর্টিং সিস্টেম (ইউ রিপোর্টার) নামক সার্ভারটিতে পরিচয় প্রকাশ না করে বুয়েটের যেকোনো শিক্ষার্থী অভিযোগ জানাতে পারতেন। বুধবার পর্যন্ত এই সার্ভারে ১০৩টি অভিযোগ জমা হয়, যার মধ্যে বেশ কিছু জমা পড়েছে গত রোববার রাতে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর।

তবে পুরানো পেজটি বন্ধ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিক্ষার্থী নির্যাতনের কথা জানাতে নতুন আরেকটি পেজ খুলেছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। নতুন এই ঠিকানাযতেও বুয়েট শিক্ষার্থীরা নাম না প্রকাশ করেই অভিযোগ জানাতে পারবেন।

বেশিরভাগ অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে

বন্ধ হওয়া পেজে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মারধর, নির্যাতন ও র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়াও রয়েছে আবাসন ও ক্যান্টিন সমস্যা, শিক্ষকদের ক্লাসের উপস্থিতি প্রভৃতি বিষয়ে অভিযোগ। পেজে যেসব বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ রয়েছে তাদের অনেকেই আবরার হত্যার ঘটনাতেও অভিযুক্ত।

বুয়েটের বিভিন্ন আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা জানান, ছাত্রলীগের নির্যাতনের ভয়েই মূলত কেউ স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করেন না। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা হলের কোনো বিষয়ে সমালোচনা করলেই শিবির-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে নির্যাতন চালায় ছাত্রলীগ। র‍্যাগিংয়ের নামেও শিক্ষার্থীদের ওপর চলে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন।

পেজে জমা হওয়া অভিযোগগুলোতে মারধর করে ছাত্রদের পায়ের রগ ছিঁড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও রয়েছে। অভিযুক্তরা সবাই বুয়েট ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে বুয়েট ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে।

এই পেজে অভিযোগ করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়নি প্রশাসন। পেজটির দেখভালের দায়িত্বে থাকা বুয়েটের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা আকবর বেনারকে বলেন, ‘দুই মাস আগেও জমা পড়া অভিযোগগুলো প্রিন্ট করে ছাত্রকল্যাণ পরিচালককে দিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।”

উল্লেখ্য, গত রোববার রাতে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। এরপর বুয়েটসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলগুলোতে ছাত্রলীগের প্রভাব ও তাদের উচ্ছৃঙ্খলতার বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল ছাত্রলীগের ‘টর্চার সেলে’ পরিণত হয়েছে। সোমবার থেকে ছাত্ররা আন্দোলন করছে।

আবরার হত্যায় আরো তিনজন আটক

এদিকে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় আলোচিত ছাত্রলীগ নেতা অমিত সাহাসহ তিনজনকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। এদের মধ্যে তার মো. মিজানুর রহমান নিহতের রুমমেট এবং অপরজন এজাহারভুক্ত আসামি হোসেন মোহাম্মদ তোহা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, এই নিয়ে আলোচিত আবরার হত্যাকাণ্ডে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো।

তবে জানা যায়, এদের মধ্যে চারজন আবরারের বাবার করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি নন।

আবরার হত্যা: বাক্স্বাধীনতার ওপর আঘাত

বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে বাক্‌স্বাধীনতার ওপর নিষ্ঠুরতম আঘাত ও ছাত্রসংগঠন তথা শিক্ষাঙ্গনের ওপর দুর্বৃত্তায়িত অসুস্থ রাজনৈতিক প্রভাবের নিষ্ঠুর পরিণতি বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।

টিআইবির পক্ষ থেকে অবিলম্বে বুয়েটসহ দেশের সকল শিক্ষাঙ্গনকে সম্পূর্ণ দলীয় রাজনীতিমুক্ত করার দাবি জানানো হয়।

আবরার হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ এবং ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানায় সংস্থাটি।

চুক্তির সমালোচনা করায় আওয়ামী লীগ নেতা বহিষ্কার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সই হওয়া চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করায় ছাত্রলীগের নির্যাতনে বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে প্রাণ দিতে হলো। আবরার হত্যার প্রতিবাদে চলমান আন্দোলনের মধ্যেই এবার একই বিষয়ে সমালোচনা করে এবার দল থেকে বহিষ্কার হলেন আওয়ামী লীগের এক নেতা।

বুধবার খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য শেখ বাহারুল আলমকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমেদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “ভারত ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চুক্তি নিয়ে শেখ বাহারুল আলম ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। এ জন্য তাকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।”

তাঁকে কেন দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রে সুপারিশ করা হবে না- আগামী সাত দিনের মধ্যে সে বিষয়ে তাঁকে জবাব দিতে বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ৫ অক্টোবর শেখ হাসিনানরেন্দ্র মোদি বৈঠকে ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার একটি শহরে সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ, ভারতের ত্রিপুরায় এলপিজি রপ্তানি, মংলা ও চট্টগ্রামের বন্দর ব্যবহার, উপকূলে রাডার স্থাপনসহ ভারতকে বেশ কিছু সুবিধা দিয়ে মোট সাতটি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি হয়।

পরদিন সেসব চুক্তির সমালোচনা করে খুলনা আওয়ামী লীগ নেতা বাহারুল আলম ফেসবুক লেখেন, “বাংলাদেশ-ভারত যৌথ চুক্তির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে স্পষ্ট হয়- সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া আর জনগণের স্বার্থে চুক্তিবদ্ধ হওয়া এক নয়।”

ভারতের সাথে করা চুক্তি বাতিল চায় বিএনপি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সই হওয়া দ্বিপক্ষীয় চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এবং চুক্তি দেশের স্বার্থহানিকর বলে অভিযোগ করেছে দলটি।

বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, “এসব চুক্তিতে দেশের অনেক স্বার্থ অনিশ্চয়তায় ঝুলিয়ে রেখে ভারতের স্বার্থ পূরণ করা হয়েছে।”

এসব চুক্তি বাতিল চেয়ে মোশাররফ বলেন, “ফেনী নদী যৌথ নদী ছিল না। অন্য আরও ৬টি যৌথ নদীর সঙ্গে এই নদীর নাম সংযুক্ত করে বর্তমান সরকার। এখন সেই নদী থেকে ভারতকে পানি দেওয়ার চুক্তি করা হলো।”

ভারতে এলপিজি রপ্তানি চুক্তিরও বিরোধিতা করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ নিজে এলপিজি আমদানি করলেও ভারতের প্রয়োজনে তা রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড ও বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগ একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে লাভবান করবে, দেশকে নয়।”

তা ছাড়া তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির বিষয়ে মীমাংসা না হওয়া, যৌথ বিবৃতিতে আসামের নাগরিক পঞ্জির বিষয়টি স্পষ্ট না থাকা, পাটজাত দ্রব্যসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানির ওপর ভারতে আরোপিত বাধা সরাতে প্রতিশ্রুতি আদায় করতে না পারায় সরকারের সমালোচনা করেন এই বিএনপি নেতা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।