বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ

শরীফ খিয়াম
2019.10.11
ঢাকা
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ বুয়েটের ভিসি প্রফেসর সাইফুল ইসলাম বুয়েট শিক্ষার্থীদের সাথে আবরার হত্যার বিচারের দাবীতে চলমান আন্দোলন নিয়ে আলোচনায় বসেন । ঢাকা, অক্টোবর ১১, ২০১৯।
ফটো: মেঘ মনির

শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। টানা পাঁচ দিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনায় বসে শুক্রবার এই ঘোষণা দেন তিনি।

উপাচার্য বলেন, “প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে আমি বুয়েটে সব ধরনের সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি। বিভিন্ন সংগঠনকে আমরা চিঠি পাঠাব, যাতে বুয়েটে তাদের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।”

“মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার কথা হয়েছে। এখানে আর কোনো ছাত্র রাজনীতি থাকবে না। আজ থেকেই সকল ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধ। এর সাথে শিক্ষক রাজনীতিও,” শিক্ষার্থীদের জানান তিনি।

“এরপরও যারা রাজনীতি করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” জানান বুয়েটের ছাত্র কল্যাণ বিষয়ক পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, “আর কখনো কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচীতে শিক্ষকেরা অংশ নেবেন না।”

এর আগে গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ আছে। বুয়েট চাইলে তারাও নিষিদ্ধ করতে পারে। আমরা এতে হস্তক্ষেপ করব না।”

আন্দোলন করা বুয়েট শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবির ছয় নম্বরে উল্লেখ ছিল, বুয়েটে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।

গত রবিবার দিবাগত রাতে তড়ি ৎ প্রকৌশল (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে (২১) পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় সম্পাদিত পানি চুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ের সমালোচনা করে আবরার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন।

ফাহাদকে হত্যার পর বিক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা, তাঁরা ঘোষণা দিয়েছিলেন, শুক্রবার দুপুরের মধ্যে উপাচার্য তাদের সঙ্গে আলোচনায় না বসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভবনে তালা লাগিয়ে দেওয়া হবে।

এরপরই উপাচার্য তাদের সঙ্গে সমঝোতা বৈঠকে বসে বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। তবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাজনীতবিদ ও শিক্ষকদের অনেকেই। ছাত্রদের এই দাবি সঠিক ছিল না বলেও মনে করেন তাঁরা।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একাত্মতা জানাতে আসা নৃ-বিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ বেনারকে বলেন, “সামগ্রিকভাবে দেশের সচেতন নাগরিকেরাও বুয়েটের এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করবেন না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্যই ছাত্র রাজনীতি থাকা উচিত।”

“সমস্যা কিন্তু রাজনীতি নিয়ে নয়, মূলত শাসকদলের মদদপুষ্ট ছাত্রসংগঠনের বেপরোয়া কর্মীরা এসব ঘটনার জন্য দায়ী। ‘ক্যাম্পাস’ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেটোয়া বাহিনী লাগবে, বড় দলগুলোর এমন ধারণার কারণে বলি হয় শত শত আবরার,” যোগ করেন ১৮ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা এই লেখক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বুয়েটের এক সহযোগী অধ্যাপক বেনারকে বলেন, “২০০২  সালের জুনে ছাত্রদলের দুই পক্ষের  গোলাগুলিতে আমাদের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীর (সাবেকুন নাহার সনি) মৃত্যুর পরও ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি এভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।”

“পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বুয়েটে ফের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। যারই ধারাবাহিকতায় ২০১০-১১ সালেই ক্যাম্পাস ও হলে ক্ষমতাসীন নেতাদের দাপট চরমে পৌঁছায়,” বলেন তিনি।

বুয়েটে  ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। বেনারকে তিনি বলেন, “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হত্যার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। তার মানে এই নয় যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে।” ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক এই সভাপতি বলেন, মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলাটা কোনো সমাধান নয়। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলে মৌলবাদীরা সুযোগ নেবে বলে মনে করেন তিনি।

বুয়েট ছাত্র সংসদের (ইউকসু) ঐতিহ্য তুলে ধরে মেনন বলেন, এখান থেকে সঠিক ধারার রাজনীতি করে অনেকেই জাতীয় নেতা হয়েছেন। আজ ১৫–১৬ বছর ধরে ইউকসু নির্বাচন হয় না। কেন হয় না, সেটি না ভেবে​ ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া হলো।

১৯ জনকে বহিস্কার

সমঝোতা বৈঠকে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ১৯ আসামিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করারও ঘোষণা দেন উপাচার্য। তিনি বলেন, “তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হলে তাদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে।”

“এর আগেও যারা ‘র‍্যাগিংয়ের’ নামে শিক্ষার্থী নির্যাতন করেছে তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান ও বহিস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে.” বেনারকে বলেন আরেক আন্দোলনকারী।

আগামী ১০ দিনের মধ্যে বুয়েট নিজস্ব তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবে জানিয়ে ভিসি বলেন, “খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে।”

উপাচার্যের দুঃখপ্রকাশ

আবরার ফাহাদের জানাজায় উপস্থিত হতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে উপাচার্য বলেন, “আবরারের ময়নাতদন্তের পর ক্যাম্পাসে যে জানাজা হবে সেই তথ্য আমার কাছে ছিল না। একটা ‘গ্যাপ’ (ব্যবধান) ছিল। পরে জানতে পেরে যখন যেতে চেয়েছি, ততক্ষণে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”

কুষ্টিয়ায় গিয়ে আবরারের পরিবারকে সান্তনা দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

উপাচার্য জানান, হত্যা মামলার যাবতীয় খরচ বহন করবে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। আবরারের পরিবারকেও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

গ্রেপ্তার ১৭, রিমান্ডে ১৬

ফাহাদ হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে শামীম বিল্লাহ (২১) নামের এক বুয়েট ছাত্রকে শুক্রবার বিকেলে সাতক্ষীরার ইছাপুর খানপুর গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার একটি বিশেষ দল।

এ নিয়ে আবরার হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ১৬ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি পেয়েছে পুলিশ। কারও কারও জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে।

শুক্রবার মোহাম্মদ তোহা ও অমিত সাহা নামের দুই আসামির পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে ঢাকার সিএমএম আদালত। এর আগে এই হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ১১ নেতাকর্মীকে স্থায়ী বহিষ্কার করে সংগঠনটি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।