নানা প্রশ্ন থাকলেও সহজে ব্যবসা করার সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.10.25
ঢাকা
নানা প্রশ্ন থাকলেও সহজে ব্যবসা   করার সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে ঢাকার কেরানীগঞ্জে একটি পোশাক কারখানায় শীতবস্ত্র তৈরি করছেন শ্রমিকরা। ছবিটি ১৬ অক্টোবর তোলা।
নিউজ রুম ফটো।

পনের মাসের ব্যবধানে দুটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন এবং সানোফি ব্যবসা গুটিয়ে নিলে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ আছে কি না–সেই প্রশ্ন ওঠে।

কিন্তু বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ বা সহজে ব্যবসা করার এ বছরের সূচকে বাংলাদেশে আট ধাপ উন্নতি করেছে। পাশাপাশি এবারের সূচকে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করা ২০ দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সূচক প্রমাণ করে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের জটিল প্রক্রিয়া সহজতর হচ্ছে। তবে তাঁরা এও বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে এখনও অনেক কিছুই বাকি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে গেলে আমাদের প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। তবে বিদেশি বিনিয়োগ আনতে গেলে ব্যবসা করার পরিবেশ আরও উন্নত করতে হবে। কারণ আমাদের সাথে প্রতিযোগিতাকারী দেশ যেমন ভিয়েতনাম অনেক বেশি ব্যবসবান্ধব। এমনকি ভারত ও পাকিস্তান আমাদের চেয়ে এ​ ক্ষেত্রে​ অনেক এগিয়ে।

ওই গবেষকের মতে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটাতে হবে, আমলাতন্ত্রিক জটিলতা কমাতে হবে, বিনেয়োগের নিরাপত্তা দিতে হবে। সর্বোপরি দুর্নীতি কমাতে হবে।

‘গ্লোবাল ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচক অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়া অন্যান্য সকল দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এ বছরের সূচকে ১৯০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮। গত বছর অবস্থান ছিলো ১৭৬।

২০২৪ সাল পর্যন্ত বর্তমান অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাবে বাংলাদেশ। আর এই অর্জনের জন্য প্রতি বছর কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হবে বাংলাদেশকে।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যানুসারে, গত বছর বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিলো তিন দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

তবে তা যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিদেশি বিনিয়োগ ডেস্কের যুগ্ম সচিব তৌহিদুর রহমান খান। তিনি সম্প্রতি অন্যত্র বদলি হয়েছেন।

বেনারকে তিনি বলেন, “খুব কম করে ধরলেও মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে প্রতি বছর আমাদের ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ দরকার।”

তৌহিদুর রহমান বলেন, “আমরা ব্যবসার পরিবেশের জন্য মূল তিন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছি। সেগুলো হলো; আমরা ব্যবসায়ীদের জমি প্রাপ্তির সমস্যা সমাধান করতে পেরেছি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা গেছে। আর বিদ্যুৎ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা আনতে পেরেছি।”

তিনি বলেন, “তবে অবকাঠামোর আরও উন্নয়ন দরকার। কারণ আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো আমাদের চেয়ে ভালো করছে।” তাঁর মতে, “আমাদের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে জবাবদিহিতা আনতে হবে। দুর্নীতি কমাতে হবে।”

প্রতিবেদন যা বলছে

ব্যবসা সহজ করার সূচকে এবার শীর্ষ স্থানে আছে নিউজিল্যান্ড। কিছুটা পিছিয়ে আছে সিঙ্গাপুর। সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে সোমালিয়া।

২০১৩ সালের পর এবারই ব্যবসার পরিবেশে উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। ওই বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ১৩০। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়ায় ১৭২।

এবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অগ্রগতির কারণ হিসেবে বলা হয়, ব্যবসা শুরু করতে আগের চেয়ে খরচ কমেছে বাংলাদেশে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর এলাকায় বিদ্যুৎপ্রাপ্তি সহজতর হয়েছে।

মোট দশটি মাপকাঠিতে একটি দেশের অর্থ-বাণিজ্যের পরিবেশের এই সূচক তৈরি করা হয়। সেগুলো হলো; নতুন ব্যবসা শুরু করা, অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি পাওয়া, বিদ্যুৎ সুবিধা, সম্পত্তির নিবন্ধন, ঋণ পাওয়ার সুযোগ, সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর পরিশোধ, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তি বাস্তবায়ন এবং দেউলিয়া হওয়া ব্যবসার উন্নয়ন।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই দশ মাপকাঠির ছয়টিতে বাংলাদেশের স্কোর গত বছরের চেয়ে বেশি।  এগুলোর মধ্যে ঋণ পাওয়ার সুযোগে বাংলাদেশের স্কোর বেড়েছে ২০ পয়েন্ট।

ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া সহজ করার পাশাপাশি বিদ্যুৎ সংযোগ ও ঋণপ্রাপ্তি সহজ করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সহজে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানান হয়েছে। বাংলাদেশে নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন ফি কমানো হয়েছে এবং ডিজিটাল সনদে মাশুল নেয়া হয় না। ঢাকায় নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ ফি অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। বৈদ্যুতিক সংযোগ পাওয়ার সময়ও কমানো হয়েছে।

শুধু অবনতি হয়েছে দেউলিয়া হওয়া ব্যবসার উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষেত্রে।

উল্লেখ্য, এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের অবস্থান ৬৩, ভুটান ৮৯, নেপাল ৯৪, শ্রীলঙ্কা ৯৯, পাকিস্তান ১০৮ ও মালদ্বীপ ১৪৭।

বিদেশি বিনিয়োগ মধ্যম আয়ের দেশ

জাতিসংঘের শর্ত অনুযায়ী, কোন দেশ স্বল্পোন্নত থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে গেলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়। এগুলো হলো; মোট জাতীয় আয় সর্বনিম্ন এক হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার, মানব সম্পদ সূচক কমপক্ষে ৬৬ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক সর্বোচ্চ ৩২ হতে হবে।

২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতি বিষয়ক কমিটি ঘোষণা করে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নয়নের তিনটি শর্ত পূরন করেছে।

কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয় সর্বনিম্ন এক হাজার ২৭২ মার্কিন ডলার, মানব সম্পদ সূচক কমপক্ষে ৭২ দশমিক ৮ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক ২৫ ছিল।

নিয়ম অনুযায়ী, আগামী ছয় বছর ওই তিন সূচকে অবনতি না হলে ২০২৪ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে বাংলাদেশ।

এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক তাদের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে ঘোষণা দেয়।

দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে স্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ্‌ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। কারণ, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে বিদেশি বিনিয়োগের বিকল্প নেই।

বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এম. মনসুর বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের কথা বলা হয়। কিন্ত মাঝে মধ্যে আমার মনে হয়, আমরা প্রকৃতপক্ষে বিদেশি বিনিয়োগ চাই কি না।”

ড. আহসান বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ না আসার অন্যতম কারণ হলো আন্তর্জাতিক সালিশি ব্যবস্থা না থাকা।

তিনি বলেন, “কোনও বিনিয়োগকারির সাথে সরকার বা অন্য কোনও পক্ষের বিরোধ হতে পারে। কিন্তু সেটি সমাধানের জন্য দেশে আন্তর্জাতিক সালিশি ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই। সুতরাং, বিনিয়োগ আনতে গেলে আন্তর্জাতিক সালিশি ব্যবস্থা চালু করতে হবে।”

দুই কোম্পানির বিদায়

দুই ওষুধ কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন এবং সানোফির বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণ স্থানীয় কোম্পানিদের উত্থানের পাশাপাশি বাংলাদেশে ব্যবসার ঝামেলাকে দায়ী করেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিইটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এম. মনসুর।

তিনি বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে অনেক পছন্দ রয়েছে। তারা কেন এখানে আসবে? এখানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তাদের ইচ্ছামত ট্যাক্স ধার্য করবে। আবার সেটি সমাধান করতে অফিসে অফিসে ঘুরতে হবে। আবার টাকা দিলে সব ঠিক হয়ে যায়। হয়তো এমন কারণেও গ্ল্যাক্সোস্মিথ এবং সানোফি বাংলাদেশ ছাড়তে পারে, যদিও তারা কোন কারণ বলেনি।”

তবে ভিন্নমত প্রকাশ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “গ্ল্যাক্সোস্মিথ এবং সানোফির চলে যাওয়া আমাদের জন্য শুভ নয়। তবে তারা তো বলেনি যে, ব্যবসার খারাপ পরিবেশের জন্য তারা চলে যাচ্ছে। অনেক সময় বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা ছোট করা অথবা কৌশলগত কারণে কোন দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।