প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর: গুরুত্ব পাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও অর্থনীতি

জেসমিন পাপড়ি
2019.06.26
ঢাকা
190626_CHINA _VISIT_PM_1000.jpg জাপানের রাজধানী টোকিওতে ‘এশিয়ার ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক সম্মেলনে বক্তব্য দিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩০ মে ২০১৯।
[এপি]

প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আমন্ত্রণে জুলাইর প্রথম সপ্তাহে চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বেনারকে জানান, “আগামী ১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী চীনের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন।”

এদিকে চীনা অর্থায়নে নির্মাণাধীন পটুয়াখালীর পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গত ১৮ জুন চীনা শ্রমিকরা এক বাংলাদেশিকে উঁচু থেকে ফেলে দিয়ে হত্যার যে গুজব উঠেছিল, তার পক্ষে কোনো কোনো প্রমাণ মেলেনি বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি

প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পাবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। তিনি এ সফরে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হবেন।

উল্লেখ্য, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্ববক বাস্তুচ্যুত ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এদের বেশির ভাগই ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে মিয়ানমারের সেনা অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা।

ড. মোমেন বলেন, “আমরা চীনকে বার্তা দিতে চাই যে, দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হলে সেখানে সন্ত্রাসী তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে। যা এখনো আমরা নিয়ন্ত্রণে রেখেছি।”

“সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়লে মিয়ানমারে চীনের যে বিনিয়োগ বা বাংলাদেশে চীনের যে সকল কার্যক্রম শুরু হয়েছে সেসব হুমকির মুখে পড়বে। মূল কথা এই অঞ্চলটা অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে চীন যে লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে তা স্তিমিত হয়ে পড়বে,” বলেন তিনি।

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে হিমশিম খাচ্ছে ঠিক তখন প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর অত্যন্ত তাৎপর্য্যপূর্ণ। কারণ, মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় আশ্রয় চীন। নিরাপত্তা পরিষদের এই শক্তিশালী সদস্যের ভেটোতেই এই ইস্যুতে বিভিন্ন রকম নিষেধাজ্ঞা থেকে বেঁচে আসছে মিয়ানমার।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের ফলে চীন যদি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারকে চাপ দেয় তাহলে সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।”

“আমার বিশ্বাস চীন প্রধানমন্ত্রীর কথা রাখবে এবং সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারকে বলবে,” বলেন তিনি।

সই হবে বেশ কয়েকটি চুক্তি

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, রাষ্ট্রীয় এই সফরে প্রধানমন্ত্রী ২ জুলাই ডালিয়ানে অনুষ্ঠিতব্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্রীষ্মকালীন বৈঠকে অংশ নেবেন।

৪ জুলাই বেইজিং এ চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং ৫ জুলাই দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে ঢাকা-বেইজিংয়ের মধ্যে জ্বালানি সহযোগিতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চারটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের কথা রয়েছে।

এ সফরকে সামনে রেখে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত জ্যাং জুয়ো।

বৈঠক শেষ চীনের রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন, “চীন বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরে বেশ কয়েকটি চুক্তি সই হতে পারে।”

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানেও তাঁর দেশ গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমার বিশ্বাস এ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের রাজনৈতিক এবং পারস্পরিক আস্থা আরও গভীর হবে।”

প্রসঙ্গত, বর্তমানে চীন বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ বৈদেশিক বিনিয়োগকারী দেশ।

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশে মোট সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে ৩,৬১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে চীনা বিনিয়োগ সর্বোচ্চ, ১,০৩০ মিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের বড়ো অংশই দেশের বিদ্যুৎ খাতে, যার মধ্যে অন্যতম পটুয়াখালীর পায়রা তাপবিদুৎ কেন্দ্র, যেখানে গত ১৮ জুন বাংলাদেশি ও চীনা শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষে এক চীনা শ্রমিক নিহত ও বেশ কয়েকজন দেশি-বিদেশি আহত হন।

এক বাংলাদেশি শ্রমিককে চীনারা উঁচু থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবার ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশি শ্রমিকরা চীনা শ্রমিকদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ায় ওই হতাহতের ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশি শ্রমিক হত্যার প্রমাণ মেলেনি

পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে গত ১৮ জুন বাংলাদেশি শ্রমিককে উঁচু থেকে ফেলে দিয়ে হত্যার যে অভিযোগ করা হচ্ছিল তার কোনো প্রমাণ মেলেনি বলে জানিয়েছেন নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খোরশেদুল আলম।

তিনি বেনারকে বলেন, “বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বয়লারের উপর থেকে ফেলে দিয়ে চীনা শ্রমিকরা বাংলাদেশি শ্রমিককে হত্যা করে বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছিল তার কোনো প্রমাণ মেলেনি।”

“নিহত বাংলাদেশি শ্রমিক নিরাপত্তা ভেস্ট পরেছিল, মাথায় হেলমেটও ছিল। কিন্তু সে নিরাপত্তা বেল্টের হুক আটকাতে ভুলে যায়। সে কারণে ১৩ মিটার ওপর থেকে নিচে পড়ে যায়। তার মৃত্যু হয়,” বলেন তিনি।

খোরশেদুল আলম বলেন, “সহকর্মীর মৃত্যুর খবর শুনে বাংলাদেশি শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। স্থানীয়দের একটি গ্রুপ চীনা বিরোধী অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে শ্রমিকদের প্ররোচিত করে এবং সহিংসতা সৃষ্টি করে।”

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এক বাংলাদেশি শ্রমিক বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকে সামনে রেখে চীনা শ্রমিকদের বাঁচাতে চাইছে সরকার।”

তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বড় কর্মকর্তারা চীনাদের কোনো দোষ দেখেন না। তারা মনে করেন তদন্ত কমিটি যদি চীনাদের দোষ দেখে তাহলে তারা টাকা দেবে না। টাকাই আসল কথা।”

তিনি বলেন, “আসলে সরকার চীনাদের রাগাতে চায় না।”

চীনা শ্রমিকরা বাংলাদেশিদের সাথে খুবই দুর্ব্যবহার করে দাবি করে ওই শ্রমিক বলেন. “তারা খুবই সংঘবদ্ধ। কিন্তু আমাদের কোনো শ্রম অধিকার নাই। আমাদের কোনো অভিভাবক নেই। ভাংচুরের ঘটনা বাংলাদেশিদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।”

এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে তদন্ত কমিটি বিদুৎ কেন্দ্রে দোভাষী নিয়োগের সুপারিশ করেছে জানিয়ে খোরশেদুল আলম বলেন, “এতে চীনা ও বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে ভাষাগত বাধা দূর হবে।”

কমিটি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে দু’দেশের শ্রমিকদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে বলেও জানান তিনি।

তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সহিংতায় এ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালুর কাজ মোটেও বাধাগ্রস্ত হবে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) শাহ্ আবদুল মওলা।

তিনি বলেন, “ইতিমধ্যে এর ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি সবকিছু কাটিয়ে আগামী ৩০ ডিসেম্বরের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৬৬০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিট আমরা চালু করতে পারব।”

প্রকল্প পরিচালক জানান, উদ্ভুত পরিস্থিতির পর বাংলাদেশি শ্রমিকদের ছুটি দেওয়া হলেও তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে। চীনারা কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশিদেরও ধীরে ধীরে কাজে ফেরানো হবে। পুরোদমে কাজ শুরু করতে কিছুটা সময় লাগবে।

বুধবার সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন তিনি।

তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সহিংস ঘটনাসহ ভাংচুরের সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলেও তিনি জানান।

এদিকে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ এ পর্যন্ত ১৪ জন বাংলাদেশি শ্রমিককে গ্রেপ্তার করেছ। পাশাপাশি, সংঘর্ষের সময় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লুট হওয়া সামগ্রী উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ।

“বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে লুট হওয়া মালামাল পাশের গ্রামগুলো থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা দেখছি কারা গোলযোগে উস্কানি দিয়েছে,” বেনারকে বলেন পটুয়াখালী জেলার পুলিশ সুপার মইনুল হাসান।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে পুলক ঘটক

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।