চীনা ঋণ: তিন বছরে ছাড় মাত্র পাঁচ শতাংশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.12.06
ঢাকা
191206_Chinese_Loan_1000.jpg বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে বেইজিংএ এক বৈঠকে তাঁর সাথে আলোচনা করছেন চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিংপিং (ডানে)। ৫ জুলাই ২০১৯।
[এএফপি]

বাংলাদেশে ২৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য চার বছরে দু হাজার কোটি মার্কিন ডলার প্রতিশ্রুত ঋণের মধ্যে চীন তিন বছরে মাত্র পাঁচ শতাংশ অর্থ ছাড় করেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশি কর্মকর্তারা।

২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে চীনের রাষ্ট্রপতি ‍শি জিংপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ২০ মিলিয়ন (দু হাজার কোটি) মার্কিন ডলার ঋণ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন দুদেশের কর্মকর্তারা। তবে সেই সমঝোতা স্মারকটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি।

প্রতিশ্রুত ঋণ ২০২০ সালের মধ্যে ছাড়ের কথা থাকলেও তিন বছরের বেশি সময় পর মোট ২৭টি প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটির বিপরীতে মিলেছে মাত্র এক বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, যা প্রস্তাবিত ঋণের মাত্র পাঁচ শতাংশ পরিমাণ। কোনো প্রকল্পেরই পুরো অর্থ ছাড় হয়নি।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এক কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে আমরা দ্রুততার সাথে ঋণ চুক্তিগুলো করার চেষ্টা করলেও এ পর্যন্ত ছয়টি ঋণ চুক্তি সম্পন্ন করতে পেরেছি। এখন পর্যন্ত চীনা সরকার পাঁচটি প্রকল্পের জন্য এক বিলিয়ন (১০০ কোটি) মার্কিন ডলারের কিছু বেশি অর্থ ছাড় করেছে।”

“আশা করা যায় আগামী বছরের জুনের মধ্যে আমরা ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের ঋণচুক্তি সম্পন্ন করতে পারব,” যোগ করেন তিনি।

‘স্বচ্ছতার অভাবে’ গণমাধ্যমে আপত্তি

প্রকল্পের অর্থ ছাড় বৃদ্ধি করতে সোমবার চীনা কর্মকর্তারা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেছেন। তবে বৈঠকের ব্যাপারে চীনা বা বাংলাদেশ কোনো পক্ষই সাংবাদিকদের কিছু জানাননি।

বৈঠকে বাংলাদেশ দলের প্রধান অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী বেনারকে বলেন, “আমরা সোমবার চীনা অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং হবে এমন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু আমরা সভার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সাংবাদিকদের কিছু জানাব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চীনারা চায় না আমরা এব্যাপারে কথা বলি।”

বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ. মনসুর বেনারকে বলেন, “চীনারা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে অনাগ্রহী। তারা চায় না বাংলাদেশ সরকারও চীনা প্রকল্প সম্পর্কে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলুক।”

তিনি বলেন, “তার কারণ হলো তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নেই। চীনারা সারাবিশ্বে যেখানে ঋণ দেয় সেখানে প্রকল্প খরচ প্রকৃত খরচের চেয়ে তিনগুণ হয়।”

“সে কারণে তারা মিডিয়াকে এড়িয়ে চলে,” যোগ করেন ড. মনসুর।

তবে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির ব্যাপারে সাবেক মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ফারুক খান বেনারকে বলেন, “প্রকল্পের খরচ দুদেশের আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। ইচ্ছা করলেই প্রকল্প ব্যয় দিনগুণ করা যায় না। এগুলো একতরফা কথা।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য চীনা ঋণ প্রয়োজন আছে। আমরা দেশের জন্য প্রয়োজনেই চীনের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছি।”

“চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার একটি ঝুঁকি আছে,” মন্তব্য করে ড. মনসুর বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যারা চীনাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে তাদের অধিকাংশই ঋণের জালে আটকা পড়েছে।

তিনি বলেন, “ঋণের জালে আটকে পড়ার একটি বড় কারণ হলো, তাদের ঋণে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর ব্যয় প্রকৃত ব্যয়ের প্রায় তিনগুণ পর্যন্ত হয়। আমাদের দেশেও এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়।”

“প্রকল্পের ব্যয় অত্যধিক হওয়ার অন্যতম কারণ হলো দুর্নীতি। চীনারা দুর্নীতির বিস্তার ঘটায়। আবার আমরাও তাদেরকে দুর্নীতির পথ দেখিয়ে দিই। এই দুর্নীতির অর্থ চীনারা এবং আমাদের দেশের যারা সংশ্লিষ্ট থাকেন তারা ভাগ করে নেন,” যোগ করেন ড. মনসুর।

ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসে চীনা ঋণের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেনারের ই-মেইলের কোনো জবাব দেয়নি।

আরেক অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বেনারকে বলেন, “চীনাদের কাছে প্রচুর অর্থ আছে। তারা ঋণ দেবে। কিন্তু আমাদের সতর্ক থাকতে হবে আমরা কোন প্রকল্পে তাদের টাকা নেব।”

“যদি আমরা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হাতে নেই সেক্ষেত্রে আমরা ঋণের ফাঁদে পড়ে যাব,” বলেন হোসেন জিল্লুর রহমান।

দীর্ঘ জটিল প্রক্রিয়া

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র এক কর্মকর্তা বেনারকে জানান, চীন থেকে অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়া দীর্ঘ।

প্রথমেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রকল্পটির সাম্ভাব্যতা যাচাই করতে হয়। সাম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করতে হয়। এর জন্য বেশ সময় প্রয়োজন হয়।

সাম্ভাব্যতা যাচাইয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য হলে বাংলাদেশ সরকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করে চীনা দূতাবাসে জমা দেয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রকল্প জমা দেয়ার পর ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস প্রকল্পটির কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। তাদের কাছে ‘কোনো সমস্যা নেই’ মনে হলে তারা চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।

চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর প্রকল্পগুলোর কাগজপত্র চীনের এক্সিম ব্যাংকে পাঠায়। ‍তারা সমস্যা না দেখলে প্রকল্পটি মূল্যায়নের জন্য একজন স্বাধীন পরামর্শকের কাছে পাঠায়।

আর পরামর্শকরা অনেক সময় নিয়ে ফেলেন। তাদের সময় বেঁধে দেয়া যায় না। তাঁরা সময় বাড়িয়ে নেন।

প্রসঙ্গত, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ঋণ চুক্তিসহ প্রক্রিয়াগত কাজগুলো তদারকি করে। আর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো থাকে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে।

অন্যদিকে চীনা কোম্পানিগুলো তাদের জনবল দিয়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে থাকে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চুক্তি অনুযায়ী, ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশকে কোনো সুদ দিতে হবে না। এর পর শতকরা দুই ভাগ অর্থ সুদ হিসাবে দিতে হবে বাংলাদেশকে।

চলমান পাঁচ প্রকল্প

কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণে মোট ৬৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ছাড় করা হয়েছে ২৬৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কিছু বেশি।

মহেশখালী একক মুরিং নির্মাণে মোট ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের মধ্যে ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ছাড় করেছে চীন সরকার।

ইনফো-সরকার নামক প্রকল্পের মোট ১৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের মধ্যে ছাড় হয়েছে প্রায় ১৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নতকরণ প্রকল্পের প্রায় ২২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ছাড় হয়েছে ৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কিছু বেশি।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মোট প্রায় ২,৬৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ছাড় হয়েছে প্রায় ৫৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ঢাকায় বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে এবছর জুলাইয়ে। তবে এখন পর্যন্ত কোন অর্থ ছাড় করেনি চীন।

এর বাইরে সীতাকুণ্ড-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ ও উপকূলীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রকল্প (২.৮৬ বিলিয়ন ডলার) ও ঢাকা-সিলেট চার লেন হাইওয়ে (২.১১ বিলিয়ন ডলার) প্রকল্পসহ বাকি ২১টি উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণ চুক্তি এখনো হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।