সরকার বিরোধীদের ভোট দেয়ায় গণধর্ষণ: নির্দেশদাতা গ্রেপ্তার

শরীফ খিয়াম
2019.01.03
ঢাকা
19003_Shubarnachar–Rape_1000.JPG নৌকায় ভোট না দেওয়ায় নোয়াখালীতে গৃহবধূ ধর্ষণকারীদের বিচারের দাবিতে ঢাকায় নারীমুক্তি কেন্দ্রের বিক্ষোভ। ২ জানুয়ারি ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

নোয়াখালীতে সরকার বিরোধীদের ভোট দেওয়ার দায়ে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণের নির্দেশদাতা আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনসহ পাঁচ অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের রাতের ওই ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে বৃহস্পতিবার নতুন সংসদ সদস্যরা শপথ নেওয়ার আগেই গ্রেপ্তার হয় তারা।

নোয়াখালীর পুলিশ সুপার (এসপি) মো. ইলিয়াছ শরীফ বেনারকে জানান, “মামলার এজাহারভুক্ত আসামি না হলেও তদন্তকালে রুহুল আমিনের নাম উঠে আসায় তাকে আটক করা হয়েছে।”

সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলী ইউনিয়নের মধ্যম-বাগ্যা গ্রামের মৃত খুরশিদ আলমের ছেলে রুহুল আমিন (৩৮), উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক এবং চরজুবলী ইউনিয়ন পরিষদের চার নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য।

‘পুলিশের এই জোর তৎপরতা প্রশংসনীয়’ উল্লেখ করে নারী অধিকার আন্দোলনের নেত্রী রোকেয়া কবীর বেনারকে বলেন, “সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে এখন এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে তাদের নাম করে কেউ নারী নির্যাতন করার সাহস না পায়।”

“সব রাজনৈতিক দলকে নারী নির্যাতনকারীদের বয়কট করতে হবে,” যোগ করেন তিনি।

সুবর্ণচরের চরজব্বার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজাম উদ্দিন ইলিয়াছ বেনারকে বলেন, “আক্রান্তরা বারবারই রুহুলের নাম বলেছে। তার নির্দেশেই গণধর্ষণের এ ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ ধর্ষিতা এবং তার স্বামী সিরাজ উদ্দীনের। বর্তমানে তারা নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।”

স্বামী সিরাজ বেনারকে বলেন, “ধানের শীষে ভোট দেওয়ার কারণে রুহুল আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল।”

নির্যাতিতার অভিযোগ, তিনি গত রোববার সকালে এলাকার পাংখারবাজার ১৪নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গেলে কেন্দ্রে থাকা আওয়ামী লীগের কয়েকজন যুবক তাঁকে তাঁদের পছন্দের প্রতীকে ভোট দিতে বলেন। তিনি তাতে রাজি না হলে যুবকেরা তাঁকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।

বুধবার দুপুরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তিন সদস্যের একটি কমিটি নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ওই নারীর সাক্ষ্যগ্রহণ করেন।

পুলিশ জানায়, বুধবার দিবাগত রাত আড়াইটায় জেলা সদরের একটি হাঁস-মুরগির খামার থেকে রুহুল আমিনকে আটক করা হয়। এর আধঘন্টা আগে সেনবাগের একটি ইটভাটা থেকে ইব্রাহিম খলিল বেচুকে (২৫) আটক করে পুলিশ।

এ ছাড়া বুধবার দুপুরে কুমিল্লার বরুরা উপজেলার মহেশপুরের একটি ইটভাটা থেকে মামলার এক নম্বর আসামি সোহেল (৩৫) এবং মঙ্গলবার রাতে লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলা থেকে তিন নম্বর আসামি স্বপনকে (৩৫) গ্রেপ্তার করা হয়। তার আগে সোমবার গ্রেপ্তার হয় ছয় নম্বর বাদশা আলম ওরফে কুড়াইল্যা বাসু (৪০)।

ওসি নিজাম বলেন, “আটকৃতরা প্রাথমিকভাবে গৃহবধূকে নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এদের তিনজনকে আদালতে সোপর্দ করে সাত দিন করে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। বাকি দুজনকে শুক্রবার আদালতে নেওয়া হবে। আগামী রোববার শুনানি হতে পারে।”

এ ছাড়া হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. খলিল উল্যাহ সাংবাদিকদের জানান, ডাক্তারি পরীক্ষার পর গণধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে।

স্বামী-সন্তানদের বেঁধে রেখে ওই গণধর্ষণ করা হয়। ঘটনার পরদিন সোমবার রাতে নয়জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন সিরাজ।

ওসি জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের করা এই মামলায় উল্লেখিত অভিযুক্তদের সবাইকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে। ফেরারি অভিযুক্তরা হলেন- হানিফ (৩০), চৌধুরী (২৫), আবুল (৪০), মোশাররফ (৩৫) এবং সালাউদ্দিন (৩৫)। এরা সবাই সুবর্ণচরের মধ্য বাইগ্গা গ্রামের বাসিন্দা।

এর আগে মামলার এজাহারে রুহুল আমিনের নাম না থাকায় চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুকের কাছে হতাশা প্রকাশ করেন নির্যাতিতা ও তার স্বামী। এ সময় ডিআইজি তাদের বলেন, “ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।”

এর কয়েকঘন্টা পরই গ্রেপ্তার হয় রুহুল।

আতঙ্কে নির্যাতিতার পরিবার

তার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে সিরাজ জানান। তবে তাঁর অভিযোগ “আমাদের এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয়েছে।”

এই সিএনজি অটোরিকশা চালকের সংসারে চারজন সন্তান রয়েছে।

মানবাধিকার কর্মী রোকেয়া কবীরের অভিমত, “আসামিদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি আক্রান্ত পরিবারটির সুরক্ষা এবং যাতে পুনরায় আক্রান্ত হতে না হয়, সেদিকেও পুলিশকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিবারটিকে ‘ভ্রুকুটি মুক্ত’ রাখতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও সক্রিয় হতে হবে।”

এসপি বলেন, “তাদের নিরাপত্তায় হাসপাতালে ও এলাকায় পুলিশ নিয়োজিত আছে।”

দেশে-বিদেশে প্রতিবাদ

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বুধবার এক বিবৃতিতে সুবর্ণচরে ঘটনার কথা উল্লেখ করে নির্বাচনে সকল অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশসহ ৪০টি মানবাধিকার সংগঠনের একটি প্লাটফর্ম এ ঘটনার নিন্দা ও জড়িত ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানায়। ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতেরও দাবি করেছে সংগঠনগুলো।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “এ ধরনের ঘটনা অবশ্যই নিন্দনীয় এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ব্যাপারে সরকার কঠোর অবস্থানে আছে।”

একইদিন এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “এই ধরনের ঘটনা কেবলমাত্র পিশাচরাই ঘটাতে পারে। মহা জালিয়াতির ভোটের পর ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা পশুপ্রবৃত্তির প্রকাশ ঘটিয়ে অনাচারে লিপ্ত হয়েছে।”

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সুবর্ণচর উপজেলার চেয়ারম্যান এএইচএম খায়রুল আনম চৌধুরী বেনারকে বলেন, “আমার ধারণাই ছিল না এই ছেলে (রুহুল) আমাদের সাংগঠনিক কোনো পদে ছিল। জানা মাত্রই তাকে বহিষ্কার করতে বলেছি। এমন অপরাধকে আমরা সমর্থন করিনি, করবও না।”

তিনি আরো বলেন, “এমপি সাহেব (মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী) এবং কাদের ভাইও (আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের) পুলিশকে ‘কড়া ভাষায়’ বলেছেন, আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধী কেউ যাতে বের হয়ে যেতে না পারে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।