একাদশ সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত: টিআইবি গবেষণা

প্রাপ্তি রহমান
2019.01.15
ঢাকা
190115_TIB_1000.jpg একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ পানাম নগরের একটি কেন্দ্রে ভোটারের অপেক্ষায় বসে আছেন একজন পোলিং অফিসার। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮।
[এপি]

ত্রিশ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘আংশিক অংশগ্রহণমূলক’ বলে আখ্যায়িত করে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে আচরণবিধির ব্যাপক লঙ্ঘনের কারণে নির্বাচনটি ছিল 'প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত'।

মঙ্গলবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি বলেছে, তাদের গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০টি আসনের মধ্যে ৪৭টি আসনে নির্বাচনের দিন কোনো না কোনো অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। আর নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে শতভাগ কেন্দ্রে।

নির্বাচন কমিশন যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে নির্বাচন কমিশন।

মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা প্রতিবেদন’ প্রকাশ করে টিআইবি।

নির্বাচনকে ঘিরে তাঁদের পর্যালোচনায় উঠে আসা অভিযোগগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার সুপারিশ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, “টিআইবি এই নির্বাচনকে আংশিক অংশগ্রহণমূলক বলছে তার কারণ নির্বাচনে সব দলের প্রার্থী থাকলেও, সবার সমান সুযোগ ছিল না।”

তাঁর মতে, “সব দলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা দেখা যায়নি। প্রতিপক্ষকে দমনে সরকারি দলের সহায়ক অবস্থান নিতে দেখা গেছে। নির্বাচনি আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে দেখা গেছে।”

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “নির্বাচনের সময় তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষদের জন্য অভূতপূর্ব কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করতে দেখা গেছে। যেটা আইনের লঙ্ঘন।”

নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব যেহেতু নির্বাচন কমিশনের, তাই এর ভালো–মন্দের দায় নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তায় বলেও টিআইবি জানায়।

প্রতিষ্ঠানটির মতে নির্বাচনে কমিশনের ভূমিকা ছিল ‘লজ্জাজনক’।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম প্রতিবেদনটি পূর্বনির্ধারিত ও মনগড়া বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি দাবি করেন, গবেষণা করতে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয়, তা এখানে প্রয়োগ করা হয়নি।

“বলা হয়েছে, এটি তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন। তার অর্থই হচ্ছে, প্রতিবেদনটি মনগড়া”, রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন।

যা দেখেছে টিআইবি

টিআইবির গবেষক দলের প্রধান ছিলেন শাহজাদা এম আকরাম। তিনি বলেন, টিআইবির পর্যালোচনাভুক্ত আসন ছিল ৫০টি।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই আসনগুলোয় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ১০৭ প্রার্থীকে তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত তাঁরা অনুসরণ করেন। সংস্থাটি পর্যালোচনায় দেখেছে গোটা সময় জুড়েই নির্বাচনের জন্য যে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ প্রয়োজন, তা ‘অনুপস্থিত ছিল’।

পর্যালোচনাভুক্ত ৪৪ আসনে (৬টি আসনের তথ্য পাওয়া যায়নি) মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকে সরকার বিরোধী পক্ষের নেতা-কর্মীদের নামে মামলা হয়েছে।

পুলিশ ও প্রশাসন হুমকি দিয়েছে, হয়রানি করেছে এবং মামলা দিয়ে সরকারবিরোধী জোটের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে।

তফসিল ঘোষণার পর থেকে ওই আসনগুলোয় ১২ হাজার ৬৮৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন তিন হাজার ৭৩৩ জন।

এর বাইরে নির্বাচনের আগে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ১৯টি আসনে সহিংসতা হয়েছে।

নেতা-কর্মীদের মধ্যে মারামারি, সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীর সমর্থক ও নেতা-কর্মীদেরকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন, হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করা, পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে ওই কেন্দ্রগুলোয়। তাছাড়া ৩৬টি আসনে বিরোধীদল প্রচারে বাধা পেয়েছ।

নির্বাচনের দিন ৫০টি আসনের ৪৭টিতেই কোনো না কোনো অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেন শাহজাদা আকরাম।

তিনি বলেন, এসব অনিয়মের ধরনের মধ্যে ছিল নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে রাখা, আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট দেয়া, ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট পেপার ভর্তি বাকশো, ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া ও প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া।

পঞ্চাশ আসনের ৪১টি আসনে জালভোট দেয়া হয়েছে এবং ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনী নীরব ভূমিকা পালন করেছে।

নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা ঘটেছে ৩৩টি আসনে এবং ২১টি আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে অথবা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে।

ত্রিশ আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারার ঘটনা ঘটেছে এবং ২৬ আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে।

কুড়ি আসনে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাকশো ভরে রাখতে দেখা গেছে এবং ২২ টি আসনে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যায়।

এছাড়া ২৯ আসনে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

প্রধান বিরোধীজোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে একই রকম অভিযোগ করা হয়। তবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে দাবি করা হয়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, “কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি ভালো”। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন ছিল, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক’।

গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক নয়

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তাঁরা পুনঃনির্বাচন চান না। তবে এ ধরনের নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য ভালো নয়।

অন্যদিকে সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি সুলতানা কামাল বলেন, “সবাই সমান সুযোগ না পেলে সংশয় থেকেই যায়। এটা গণতন্ত্রের জন্য ভালো উদাহরণ রাখে না। নির্বাচন পরিচালনায় প্রচুর ত্রুটি ছিল। এজন্য আমরা বলছি, ত্রুটিগুলো সংশোধন করে সামনের নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু করবেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।