নারী অথবা পুরুষ হয়েই ভোট দিতে হবে হিজড়াদের

জেসমিন পাপড়ি
2018.11.02
ঢাকা
181102_Third_Gender_900.jpg নিজেদের অধিকারের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে হিজড়াদের মানববন্ধন। ৩০ নভেম্বর ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

সরকার স্বীকৃতি দিলেও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘হিজড়া’ লিঙ্গ হিসেবে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকেরা। আগের মতো ‘নারী’ অথবা ‘পুরুষ’ হিসেবেই ভোট দিতে হবে তাঁদের।

ভোটার তালিকার সিডি তৈরি হয়ে যাওয়ায় হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আলাদা করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

কমিশনের প্রস্তুতি অনুযায়ী, আগামী ৪ নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল চূড়ান্ত করতে সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিদ্যমান ভোটার তালিকায় হিজড়ারা ‘নারী’ অথবা ‘পুরুষ’ হিসেবেই অন্তর্ভুক্ত আছেন।

স্বীকৃতি পাওয়ার পাঁচ বছর পরেও ভোটার তালিকা সম্পন্ন না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী। বিষয়টি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন বলে মনে করছেন তাঁরা।

“বিষয়টি ন্যাক্কারজনক। এতদিন ধরে আমাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অথচ আমাদের সেই স্বীকৃতির প্রতিফলন এখনো দেখতে পাচ্ছি না,” বেনারকে বলেন সামিউল আলম ওরফে শাম্মি হিজড়া।

নির্বাচন কমিশনের যুগ্মসচিব (জনসংযোগ) এস এম আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, “আমাদের প্রায় সাড়ে ১০ কোটি ভোটার। নির্বাচনের আগে দুটি ভোটার তালিকা তৈরি হয়ে আছে। এখন নতুন করে তৃতীয় লিঙ্গ সংযুক্ত করতে গেলে তালিকা ‘মিসম্যাচ’ হয়ে যাবে। এখন এটি করা সম্ভবও নয়। কারণ আইন সংশোধন করতে হবে, নতুন করে ফরম ছাপাতে হবে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এর আগে একবার নমুনা হিসেবে ব্যালট পেপারে নারী ও পুরুষের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গ অপশনটি যুক্ত করা হয়েছিল, যাতে ভোট গণনার সময় নারী, পুরুষ ও তৃতীয় লিঙ্গ আলাদা করা যায়। কিন্তু ভোটার তালিকা সংশোধন না করে এটা চূড়ান্তভাবে করা যাবে না।”

“তবে নির্বাচন কমিশনের নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে মহিলা, পুরুষের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে তালিকা করার। তবে তা সময়সাপেক্ষ, পর্যায়ক্রমে এটি করা হবে,” জানান আসাদুজ্জামান।

হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির ডেপুটি ম্যানেজার (প্রশিক্ষণ) মেজবাহউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “বিষয়টা দেখি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা হিসেবে। এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের সমন্বয়হীনতার বড় রকমের অভাব রয়ে গেছে।”

তিনি বলেন, “এই জনগোষ্ঠীর প্রতি সামাজিক যে অবহেলা বা নেতিবাচক যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে সেটা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বিদ্যমান আছে কিনা সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।”

তাঁর মতে, নির্বাচন কমিশন ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যদি সুষ্ঠু সমন্বয় থাকত, তাহলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগেই ভোটার তালিকার কাজ শেষ হতো। কারণ, স্বীকৃতির পর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন বা অন্যান্য সরকারি কাগজপত্রে হিজড়াদের স্বীকৃতির বিষয়টা আসেনি,” বলেন মেজবাহউদ্দিন আহমেদ।

সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালের নভেম্বরে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়।

এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও হিজড়াদের নিজ পরিচয়ে ভোট দিতে না পারা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বেনারকে বলেন “এ জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমিও ইসিকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। তবে সময় সাপেক্ষ বিষয় বলে তা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে কমিশন।

তবে ইসির প্রতি তাঁর অনুরোধ, “ভোট কেন্দ্রে গিয়ে হিজড়াদের বিড়ম্বনা এড়াতে নারী ও পুরুষের পাশাপাশি একটি আলাদা বুথের ব্যবস্থা যেন করা হয়। তাদের যেন নারী বা পুরুষের লাইনে দাঁড়াতে না হয়। প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছি।”

গত ১৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের ৩৬তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কমিশন সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানান, হিজড়া জনগোষ্ঠীকে ‘হিজড়া’ লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। যে কারণে ভোটার তালিকায় নারী ও পুরুষের মতো হিজড়াদেরও পৃথক লিঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে এবং এ বিষয়ে আইনি বাধ্যবাধকতাও দেখা দিয়েছে।

তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হিজড়াদের জন্য আলাদা ভোটার তালিকা তৈরি করা সম্ভব নয় বলে সভায় জানান নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী।

সভায় সিদ্ধান্ত হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভোটার তালিকা বিধিমালা সংশোধন করে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে কোনো হিজড়া ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচন কমিশনে যোগাযোগ করলে তাঁর তথ্য সংশোধন করে ‘নারী’ অথবা ‘পুরুষ’–এর স্থলে ‘হিজড়া’ করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।