জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীদের শপথ নেওয়া অনিশ্চিত

শরীফ খিয়াম ও জেসমিন পাপড়ি
2018.12.31
ঢাকা
181231_BD_Election_F_UP_1000.jpg ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮।
[এএফপি]

একাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৫৬টি আসনে অভাবনীয় জয় পেয়ে আবারও সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে ‘নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির’ অভিযোগ তুলে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন আয়োজনের দাবি তুলেছে মাত্র সাতটি আসন পাওয়া বিরোধী দলীয় জোট জাতীয় ঐকফ্রন্ট।

তবে সে দাবি নাকচ করে দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা সোমবার বলেছেন, “নতুন করে নির্বাচনের আর সুযোগ নেই।”

নির্বাচনের পরদিন বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে এসে এবারের নির্বাচনে ৮০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে জানিয়ে সিইসি জানান, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। ভোটে কোনো অনিয়ম হয়নি। তাই ভোটে তাঁরা লজ্জিত নন।

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপির নিজের দোষেই নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন প্রশংসাযোগ্য ও স্বচ্ছ ছিল। গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে এ মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে বিএনপির যে ক'জন প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, তাঁরা কেউ শপথ নেবেন না বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সোমবার বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলীয় এ সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, “আমরা তো একাদশ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছি। নতুন নির্বাচনের দাবি করেছি। ফলে সংসদে যোগ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।”

বিএনপির মহাসচিব বলেন, “এই নির্বাচনে প্রমাণ হয়ে গেছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে কখনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। সরকার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগসাজশ করে এমন একটা নির্বাচন করল, যেটা জাতির রাজনৈতিক ইতিহাস ও নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময় ঘটনা বলে মনে করি।”

নির্বাচন পরবর্তী সময়ে দলের করণীয় নির্ধারণ করতে এদিন বৈঠকও করেছে দলটির শীর্ষ নেতারা।

নির্বাচন শেষ হয়ে যাবার পর নির্বাচনী পোস্টর সংগ্রহ করছেন এক যুবক। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮।
নির্বাচন শেষ হয়ে যাবার পর নির্বাচনী পোস্টর সংগ্রহ করছেন এক যুবক। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮।
[এপি]

স্মারকলিপি দেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট

একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে জোটের প্রার্থীদের নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) স্মারকলিপি দেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। একই সঙ্গে পরববর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবে তাঁরা। আগামী দু’একদিনের মধ্যেই এটি করা হবে বলে জানিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন।

ঐক্যফ্রন্ট সূত্র জানায়, ৩০০ আসনে অংশ নেওয়া ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের সঙ্গে আগামী ৩ ডিসেম্বর মতবিনিময় করবেন শীর্ষ নেতারা। এরপর প্রার্থীদের নিয়েই নির্বাচন কমিশনে যেতে পারেন।

রোববার অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ২৯৮টি আসনের ফলাফল বেসরকারিভাবে ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থীরা। দলগতভাবে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২৫৬টি আসন।

এর বিপরীতে বিরোধীদলীয় জোট ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা জিতেছেন সাতটি আসনে। এর মধ্যে বিএনপি পেয়েছে পাঁচটি আসন, বাকি দুটি গণফোরাম। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন তিনটি আসনে।

সন্তুষ্ট সিইসি

সোমবার সংবাদ সম্মেলনে সিইসি নূরুল হুদা বলেন, ভোটারেরা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ভোট দিয়ে নতুন সরকার গঠনের সুযোগ করে দিয়েছে। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে যা দেখেছি তাতে মনে হয়েছে জাতি গতকাল ভোট উৎসবে মেতেছিল।

“দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে সে জন্য আমরা দুঃখিত,” বলেন তিনি।

এবারের নির্বাচনে ৮০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে জানিয়ে সিইসি বলেন, অনিয়মের কারণে ১৬টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করা হয়েছে।

প্রার্থীদের মধ্যকার বিরাট ভোট ব্যবধানের বিষয়ে জানতে চাইলে সিইসি বলেন, “জনগণ ভোট দিয়েছে তাই ভোটের এত পার্থক্য। সুতরাং, নতুন করে আমরা নির্বাচন দেবো না।” আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগও ‘অসত্য’ উল্লেখ করেন তিনি।

আরও বড় দায়িত্ব: শেখ হাসিনা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়কে দেশবাসীর জন্য মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের আরেকটি বড় বিজয় বলে অভিহিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা বলেন, “এ বিজয় আমার ব্যক্তিগত কোনো লাভের জন্য নয়। বরং এই বিজয় দেশ ও জনগণের প্রতি আরও বড় ধরনের দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়।”

শেখ হাসিনাকে ফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। সোমবার সকালেই ফোন করেন তিনি। এ ছাড়া শুভেচ্ছা জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংসহ বিশ্বের অন্যান্যরা নেতারা।

নিরঙ্কুশ বিজয়’ নিয়ে শঙ্কা

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ‘নিরঙ্কুশ বিজয়’ কতটা স্বস্তিদায়ক হবে তা নিয়ে শঙ্কা দেখছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, নতুন সংসদ ও সরকারের ‘নৈতিক ভিত্তি’ দুর্বল হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আলী আর রাজী বেনারকে বলেন, “আওয়ামী লীগ যে জয় পেয়েছে তা ভয়ঙ্কর। এই জয়ের যে ব্যাবধান তা এই ভয়ের কারণ।

এতে বোঝা যাচ্ছে, কোথাও বড় ধরনের ‘কুম্ভিলকবৃত্তি’ ঘটেছে।”

তাঁর মতে, “সরকার যত বড় বিজয় পেয়েছে, তাদের নৈতিকতা নিয়ে ততো বড় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এই নৈতিকতার প্রশ্ন চেপে রেখে দীর্ঘসময় ধরে রাজনীতিতে কর্তৃত্ব করা দুরূহ হয়ে ওঠার শঙ্কা থাকবে।”

নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “এই নির্বাচনে মহাজোটের ‘মহাবিজয়’ আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ‘মহাপরাজয়’ কোনো ‘মহাবিপর্যয়’ ডেকে আনবে কিনা, এখন সেদিকে নজর দিতে হবে।”

ড. বদিউল বলেন, “নির্বাচন নিয়ে এখন অভিযোগ অনেক উঠেছে। অনেক অভিযোগের সতত্যাও রয়েছে। নির্বাচনী পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারীতা নিয়ে সব পক্ষকেই নির্মোহভাবে ভাবতে হবে।”

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম আনোয়ার হাশিমও এই নির্বাচনের ফলাফলকে ‘অভূতপূর্ব, অস্বাভাবিক, অপ্রত্যাশিত, অচিন্ত্যনীয়,’ এমনকি ‘অকল্পনীয়’ বলেও উল্লেখ করেছেন।

“ভোটব্যাংক বলে কিছু থাকলে একটি বড় দল বা জোট মাত্র সাতটা আসন কী করে পায়?”- এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “এই ফলাফল কোনো পাগলেও বিশ্বাস করবে না। বাংলাদেশের দুটি বড় দলের ভোটব্যাংকে কমপক্ষে ৩০-৩২ শতাংশ ভোট রয়েছে।”

এদিকে ভারতকেন্দ্রীক গবেষণা সংস্থা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন সোমবার ‘বাংলাদেশ এখন এক দলীয় গণতন্ত্রের দেশ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।

এতে নিবন্ধ লেখক কাঞ্চন গুপ্ত মন্তব্য করেন, “সব দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ কার্যত এখন একটি একদলীয় রাষ্ট্র, যেখানে গুরুত্বহীন অন্য দলগুলো দেশের সংবিধানের বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিধানটিকে টিকিয়ে রেখেছে মাত্র।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।