নির্বাচনের আগে ইভিএম বিতর্কে উত্তপ্ত রাজনীতি

পুলক ঘটক
2018.08.31
ঢাকা
     ইভিএমের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অাগস্ট ৩০, ২০১৮।
নিউজরুম ফটো।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার প্রশ্নে পরষ্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, যা রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব বৃহস্পতিবার অনুমোদন করেছে নির্বাচন কমিশন—ইসি। কমিশনের এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে সরকার। আর রাজনীতিতে মূল বিরোধীদল বিএনপিসহ প্রায় সবাই এর বিরোধীতা করছে।

তবে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল এবং একই সঙ্গে জোট সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টিও মনে করে, ইভিএম চালু করার মতো সময় সরকারের হাতে নেই।

জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদের বেনারকে বলেন, “ইভিএম প্রবর্তনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য আইনটি সংশোধন হওয়া দরকার। তবে আসন্ন নির্বাচনে সেটা ব্যবহার করতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে আগে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা।”

“সবাই এই প্রযুক্তিকে আস্থায় না নিলে উদ্যোগটি সফল হবে না,” মনে করেন জিএম কাদের।

নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, আরপিও সংশোধনে কমিশনের প্রস্তাবটি এখন নিয়ম মাফিক আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যাবে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হলে তা আইনের সংশোধনী বিল আকারে জাতীয় সংসদে যাবে।

আগামী ৯ সেপ্টেম্বর দশম জাতীয় সংসদের সর্বশেষ ও সংক্ষিপ্ত অধিবেশন শুরু হবে। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে জানিয়েছে, আগামী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সব বিরোধীতা সত্ত্বেও জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় আ​ইনটি পাস করতে আওয়ামী লীগ কোনওরকম প্রতিবন্ধকতায় পড়বে না। তবে এর ফলে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ও সংশয় বাড়বে এবং একটি সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি হওয়ার আশংকা রয়েছে ।

“এই সময়ে ইসির দায়িত্ব হচ্ছে স্বচ্ছভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যে একটি নির্বাচন আয়োজন করা। যে প্রযুক্তি বিরোধী দলগুলো ভয় পাচ্ছে একতরফাভাবে সেটা চালু করে পরিবেশ আরও বিরোধপূর্ণ করে তোলা উচিত হবে না,” বেনারকে বলেন সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসেন বেনারকে বলেছেন, “আধুনিক এই প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাই। তবে সেটা চালুর আগে সব মহলের আস্থা ও সমর্থন দরকার।”

কমিশনে মতবিরোধ

ইভিএম ব্যবহারের জন্য আইন সংশোধনের প্রস্তাবে লিখিত আপত্তি জানিয়ে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচন কমিশনের সভা থেকে বেরিয়ে যান কমিশনার মাহবুব তালুকদার। এ বিষয়ে নিজের অবস্থান খোলামেলাভাবে গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরেন তিনি।

সাংবিধানিক পদে থাকা একজন কমিশনারের এ​ই অবস্থানের ফলে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে চলমান বিতর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে এবং তা রাজনীতির মূল বিতর্কে পরিণত হয়েছে।

কমিশনের সভা থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের মাহবুব তালুকদার বলেন, “তিনটি কারণে আমি আপত্তি দিয়েছি। প্রথমত: অধিকাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ত: জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার মতো প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি আছে। প্রশিক্ষণ দিতে যে সময়ের দরকার, তা আমাদের হাতে নেই। তৃতীয়ত: ইভিএম ব্যবহারে ভোটারদের মধ্যে অনীহা রয়েছে। তাদের মধ্যে অভ্যাস গড়ে ওঠেনি।”

তিনি বলেন, “যন্ত্রের অগ্রগতির সময়ে আমি মোটেও ইভিএম ব্যহারের বিপক্ষে নই। কিন্তু আমি মনে করি, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে যে প্রস্তুতি দরকার, তা আমাদের নেই।”

তবে বৈঠকের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন, “আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত এখনও আমরা নেইনি। তবে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছে।”

তিনি বলেন, “ইভিএম ব্যবহার করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভালো ফল পেয়েছি। যাতে সংসদ নির্বাচন তা ব্যবহার করা যায় সে প্রস্তুতি নিতেই আমরা আইন সংশোধনের প্রস্তাব করেছি।”

কমিশনের প্রস্তুতি

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রায় ১০০ আসনে ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহার করতে চাইছে নির্বাচন কমিশন। এ জন্য দেড় লাখ ইভিএম কিনতে ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলাল উদ্দিন বেনারকে বলেছেন, “ইভিএম প্রবর্তনের লক্ষে একটি ৫ বছর মেয়াদি প্রকল্প প্রস্তাব আমরা সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হল ভোট প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, ত্রুটিমুক্ত, বিশ্বাসযোগ্য ও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর করা।”

বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের যাত্রা শুরু হয়েছিল এ টি এম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসির হাত ধরে ২০১০ সালে। তখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় ইভিএম তৈরি করে স্থানীয় নির্বাচনে ব্যবহার শুরু হয়েছিল।

কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ইভিএম নিয়ে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) সহায়তায় তৈরি করা হয় ‘ডিজিটাইজড ইভিএম’।

নির্বাচন কমিশনের কারিগরি বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য অধ্যাপক মো. হায়দার আলী বেনারকে বলেন, “এখন কমিশন যে ইভিএম প্রবর্তন করতে চাইছে সেগুলো অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে উন্নত প্রযুক্তির। আঙ্গুলের ছাপ এবং জাতীয় পরিচয় পত্রের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ভোটারকে সনাক্ত করা পর ব্যালট ইস্যু করা হবে। ফলে জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।”

যান্ত্রিক কারচুপির সন্দে​হ

ইভিএম ব্যবহার করে আসন্ন নির্বাচনে যান্ত্রিক কারচুপি করা হবে কিনা, তা নিয়েই শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার ঢাকায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আওয়ামী লীগ এখন জনগণের ওপর আস্থা হারিয়ে যন্ত্রের ওপর ভর করছে। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের একটি অশুভ পদক্ষেপ।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ শুক্রবার ঢাকায় এক আলোচনা সভায় বলেন, “যারা এই মেশিনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং যাদের কাছে পাসওয়ার্ড থাকবে—সেই নির্বাচন কমিশনের ওপরে আমাদের আস্থা নেই। তাই আমরা এটা প্রত্যাখান করি।”

এদিকে শুক্রবার সিলেটে সাংবাদিকেদের সঙ্গে আলাপকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “ইভিএম নিয়ে বিএনপির অভিযোগ অবান্তর। বিএনপি এর বিরোধিতা করছে কারণ ইভিএম পদ্ধতিতে নির্বাচনে হেরে গেলে অজুহাত দেওয়ার থাকবে না।”

তিনি বলেন, “ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে পাঁচ কমিশনারের মধ্যে একজন ভিন্ন মত দিতেই পারেন। এটিই গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। এতে আমাদের কিছু বলার নেই।”

ইভিএম প্রবর্তন এবং আইন সংশোধনের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বেনারকে বলেছেন, “ডিসেম্বরে নির্বাচন। এর মধ্যে এই প্রযুক্তি চালু করার সিদ্ধান্ত ভালো কোনও লক্ষণ নয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।