তৈরি পোশাক শিল্পের শনৈ শনৈ উন্নতি, তবু শ্রমিকের সংগ্রাম থামে না

জেসমিন পাপড়ি
2019.08.16
ঢাকা
তৈরি পোশাক শিল্পের শনৈ শনৈ উন্নতি, তবু শ্রমিকের সংগ্রাম থামে না গার্মেন্টস শ্রমিক শিপা আক্তার (ডানে) এবং তার স্বামী রুবেল হোসেন গার্মেন্টসে কাজে যাওয়ার জন্য দক্ষিণখানের বাসা থেকে বের হচ্ছেন। জুলাই ২০, ২০১৯।
জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ

তাঁর দেশের তৈরি পোশাক খাত রপ্তানীতে রেকর্ড গড়েছে। কিন্তু এই খাতেরই কর্মী শিপা আক্তারের সন্তানদের ঢাকায় নিজের কাছে রাখার সামর্থ্যটুকু নেই। শিপা আসলে সেই লাখ লাখ শ্রমিকের একজন যাদের দিনের লম্বা সময়টা কেটে যায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশের’ লেবেল লাগানো পোশাক তৈরিতে।

এই খাতে শিপার পথ চলা সাত বছরের। এখন তাঁর বয়স চব্বিশ। রাজধানী ঢাকার কেন্দ্র থেকে একটু বাইরের দিকের একটি কারখানায় তাঁর কাজ জুটেছে সিনিয়র সিইউয়িং অপারেটর হিসেবে। এই কারখানায় প্রতিদিন ১৪ ঘণ্টা কাজ করে মাসে আয় করেন নয় হাজার ৪২৫ টাকা।

“এই চাকরিটার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিয়েছি আমরা। আমাদের সন্তানের সান্নিধ্য, সামাজিকতা – সব। আমরা শুধু কারখানায় কাজ করি - ব্যাস,” শিপা বেনারনিউজকে বলছিলেন। আমরা বলতে তিনি বোঝাচ্ছিলেন তাঁকে ও তাঁর স্বামী রুবেল হোসেনকে। তাঁরা দুজন একই কারখানার কর্মী।

যেখানে বসে কথা হচ্ছিল, সেটা ওঁদের ভাড়া বাসা। বাসা না বলে ঘর বলাই শ্রেয়। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে দক্ষিণখানে ঘিঞ্জি একটা ঘরের একটা ওদের, ওপরে টিনের চাল।

এই দম্পতির ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নেই। শৌচাগার, গোসলখানা আর রান্নাঘর প্রতিবেশীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে হয়েছে তাঁদের।

“ঘুম থেকে উঠে আমি প্রথমেই ভিডিও কল করে ছেলেটাকে দেখি। মাসের পর মাস যায়, একবার ওকে ছুঁয়েও দেখতে পারি না,” শিপা বলছিলেন।

শিপার দুইবছর বয়সী সন্তান শিহাব তার দাদীর কাছে চট্টগ্রামে থাকে, ঢাকা থেকে যে জায়গার দূরত্ব প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার।

“নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম প্রতিদিন বাড়ছে। তাই বাধ্য হয়ে সন্তানকে দূরে রাখতে হয়েছে,” রুবেল বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, দিন এনে দিন খান তাঁরা। শিহাবের বয়সী একটা শিশুর যে যত্ন দরকার সেটা করা প্রায় অসাধ্য।

হোসেন বলছিলেন, চিত্তবিনোদনের কোনো সুযোগই নেই তাঁদের। কারণ ছুটির দিনেও তাঁদের প্রায়ই কারখানায় কাজে যেতে হয় ।

 

শিপা আক্তার তাঁদের দক্ষিণখানের বাসার ভাগের রান্নাঘরে রাঁধছেন, জুলাই ২০, ২০১৯ (জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ)
শিপা আক্তার তাঁদের দক্ষিণখানের বাসার ভাগের রান্নাঘরে রাঁধছেন, জুলাই ২০, ২০১৯ (জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ)

 

কাজের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা-মজুরি বাড়ল সামান্যই

শিপার দিন শুরু হয় ভোর ৬টায়। কারখানায় গিয়ে পৌঁছাতে হয় ঠিক ৮টায়। সেখানে থাকেন রাত ১১ টা পর্যন্ত। ওভারটাইমের টাকাটার জন্য প্রতিদিন অতিরিক্ত প্রায় পাঁচঘন্টা কাজ করেন তিনি।

যে জায়গাটায় বসে প্রতিদিন শার্ট সেলাই করেন সে জায়গাটা থেকে দিনে একঘণ্টার একটা বিরতি পান দুপুরের খাবারের জন্য। রাত ৮টার দিকে পাঁচ মিনিটের বিরতি পান হাল্কা একটা নাশতার জন্য। এই নাশতাটা দেওয়া হয় যেন শক্তির খামতি না হয়।

শিপা বলছিলেন, যেদিন অনেকটা রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়, সেদিন স্বামীর সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে, গৃহস্থালির কাজ-কর্ম সেরে শুতে শুতে রাত ১ টা বাজে।

এখন শিপার মাসিক বেতন গত বছরের তুলনায় ৩৭ শতাংশ বেড়ে ১১১ ডলার হয়েছে। কিন্তু ত্রিশ ডলারের এই বাড়তি আয় তাঁর কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

শিপা বলছিলেন তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা যাঁরা সারি বেঁধে কাজ করেন প্রতিদিন, তাঁদের সবাইকে আগের চেয়ে প্রতি ঘন্টায় বেশি কাজ করতে হয়।

তিনি বলছিলেন, সবসময় তাঁর ভয় হয়। অতিরিক্ত কাজ দেখাতে না পারলে কিংবা ওভারটাইম না করলে সহজেই মালিক হয়তো তাঁকে ছাঁটাই করে দেবেন।

“সামান্য ক’টা টাকার বিনিময়ে সাধ্যের চেয়ে বেশি কাজের বোঝা! যখন আমি ছয় হাজার ৮০০ টাকা ( সাড়ে আশি ডলার ) বেতন পেতাম, তখন কাজের চাপটা আয়ত্বের মধ্যে ছিল। এখন চাকরি হারানোর ভয়ে, টয়লেটে যাওয়ার আগে দু’বার ভাবি,” শিপা বলছিলেন।

“এখন সবসময় কাজের উপযুক্ত থাকতে ওষুধ খাই,” শিপা বলেন। তিনি আরও বলছিলেন, “মজুরি হিসেবে যেটুকু বাড়ল, তা ওষুধ কিনতেই শেষ।”

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি, যেটি কি না প্রতিনিয়ত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করে থাকে - সে খাতের কর্মীদের স্বাস্থ্য বীমা নেই। মালিকরা সে ব্যবস্থা রাখেননি।

গত ডিসেম্বরে শিপা ও তৈরি পোশাক খাতের সব কর্মীর মজুরি বেড়েছে। সরকার সবার জন্য মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়, ন্যুনতম মজুরি গিয়ে দাঁড়ায় মাসে পাঁচ হাজার তিনশ টাকায় ( ৬৩ ডলার )।

“কর্মীরা যারা আগে ১০০ টা পোশাক সেলাই করত ঘন্টায়, এখন তাদের ১২০ থেকে ১৩০ পিস পোশাক সেলাই করতে হচ্ছে,” গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক কে এম মিন্টু বেনারনিউজকে বলেন।

প্রতিবছর তৈরি পোশাক খাত রপ্তানিতে রেকর্ড গড়ছে এবং রপ্তানি খাতগুলোর মধ্যে শীর্ষে থাকছে।

বিজিএমইএর পরিসংখ্যান বলছে, তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেড়েছে ৩৪ দশমিক এক বিলিয়ন ডলার। দশবছরে এই বৃদ্ধি প্রায় তিনগুণ। বাংলাদেশের ৪০ দশমিক পাঁচ বিলিয়ন রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের অবদান।

তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেম গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)র কর্মকর্তা আবদুস সালাম বলছেন, তারা কর্মীদের কাছ থেকে আরও বেশি উৎপাদন আশা করেন।

“ বেতন ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ব্যয় সামাল দিতে উৎপাদনও বাড়াতে হবে। সে কারণেই কর্মীদের উৎপাদন বাড়াতে বলা হচ্ছে ” তিনি বেনারকে বলেন।

”ভিয়েতনামের শ্রমিকদের উৎপাদন বাংলাদেশীদের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। আমাদের কর্মীদেরও ওই রকম দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

শিপার কর্মজীবন শুরু ২০১২ সালে তাঁর নিজের জেলা চট্টগ্রামে। তিন হাজার ৫০০ টাকায় সহকারীর পদে কাজ শুরু করেছিলেন। পরের বছরই অপারেটর হন। ২০১৫ সালে স্বামীকে নিয়ে শিপা ঢাকায় চলে আসেন।

এখন শিপার মনে হয়, তিনি ও তাঁর স্বামী কাজের একটা গোলকধাঁধায় আটকা পড়েছেন। তাঁকে সামান্য কিছু প্রাপ্তির বিনিময়ে কাজ করে যেতে হবে। তাঁদের শ্রম আর ঘামের বিনিময়ে, যেখানে কারখানা মালিক আর ওপরের দিকে থাকা কর্তা ব্যক্তিরা বড় অঙ্কের লাভ করে থাকেন এমন তথ্য রয়েছে।

“কাজ ছেড়ে দিলে খাব কি? প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘরভাড়া দিতেই হবে, একজন মানুষের আয়ে সংসার চলে না, বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছে টাকা পাঠানো যায় না। তাই দিন রাত দুজন খেটে মরি,” শিপা বলেন।

“চাকরি চলে যাবার ভয়ে কাউকে যখন ছাঁটাই করা হয়, তখন কেউ মুখও খোলে না,” শিপা বলছিলেন। তিনি আরও বলেন, এখানে চাকরি যাওয়াটা সবচেয়ে সোজা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।