পোশাক কারখানা তদারকি করবে নতুন সংগঠন ‘আরএসসি’

জেসমিন পাপড়ি
2019.09.04
ঢাকা
190904_RSC_1000.JPG ঢাকার মিরপুর এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকরা। ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
[নিউজরুম ফটো]

পোশাক শিল্পে নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে নতুন প্ল্যাটফর্ম আরএমজি সাসটেইনিবিলিটি কাউন্সিলের (আরএসসি) গঠন নীতিমালা আগামী ২৫ নভেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি . রুবানা হক।

টানা দুই দিন আলাপ-আলোচনা শেষে গত মঙ্গলবার আরএসসি গঠনের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছান কারখানা মালিক, বিদেশি ক্রেতা শ্রমিক নেতাদের ত্রিপক্ষীয় প্রতিনিধিরা। পরে যৌথ বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

কারখানা পরিদর্শন সংস্কারে ইউরোপীয় ২২৮টি ক্রেতার সমন্বয়ে গঠিত অ্যাকর্ড বাংলাদেশ ছাড়ার আগে এই জোটের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে। রুবানা হক জানান, পোশাক কারখানা সংস্কারে অ্যাকর্ডের বাকি কাজ এগিয়ে নেবে আরএসসি।

বিষয়টিকে ইতিবাচক বলছেন তৈরি পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা। নতুন এই তদারকি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তৈরি পোশাক কারখানা সংস্কার নিয়ে মালিকপক্ষ ও অ্যাকর্ডের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ ঘুচবে বলে মনে করছেন তাঁরা। নতুন জোটে নিজেদের প্রতিনিধি থাকায় স্বস্তিবোধ করছেন শ্রমিক নেতারাও।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক জাফরুল হাসান বেনারকে বলেন, “অ্যালায়েন্স চলে গেছে। অ্যাকর্ড একটা জায়গায় দায়িত্ব হ্যান্ডওভার করে চলে যাবে। এমন প্রেক্ষাপটে সবপক্ষ মিলেই আরএসসি গঠন করা ইতিবাচক।

সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বেনারকে বলেন, “আরএসসি নিয়ে আমরা পজিটিভ। যেহেতু এটার উদ্দেশ্য কারখানার নিরাপত্তার জন্য কাজ করা; পোশাক খাতের উন্নয়ন করা।

আমরা অর্থ্যাৎ ট্রেড ইউনিয়ন আরএসসির একটি অংশ। এখনো এটি গঠন পর্যায়ে আছে। তবে কাজ করার সময় যদি দেখি, যে উদ্দেশ্যে গঠন হয়েছে সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তখন নিশ্চয় বিকল্প ভাবা হবে,” বলেন তিনি।

শ্রমিক অধিকার উপেক্ষিত

বিলসের নির্বাহী পরিচালক জাফরুল হাসান বলছিলেন, “অ্যাকর্ডের অনেক কার্যকমে মালিকপক্ষ বিরক্ত ছিল। তারা মনে করত পোশাক খাতে বাইরের শক্তি হস্তক্ষেপ করছে।

তবে বর্তমানে পোশাক কারখানাগুলোতে যে পরিবেশগত উন্নয়ন হয়েছে তা অ্যাকর্ডের এই কার্যক্রমের কারণেই। অ্যাকর্ডের কারণেই এত অল্প সময়ে এই উন্নতি হয়েছে,” বলেন তিনি।

তবে সেই তুলনায় শ্রমিকদের অধিকারের দিক উন্নতি হয়নি বলে মনে করেন বিলসের নির্বাহী পরিচালক।

তিনি বলেন, “শ্রমিকদের অধিকারের দিকটা এখনো উপেক্ষিত। উচ্চ পর্যায়ে ট্রেড ইউনিয়নের সম্পৃক্ততা আছে। কিন্তু নিচের দিক সেইভাবে নেই। ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা থাকলেও তারা পোশাক শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারছে না।

পোশাক খাতে কর্মচারী ছাঁটাইসহ এখনো নানা সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর ব্যাপারে ভালো কোনো উদ্যোগ নেই,” জাফরুল হাসান বলেন।

বিলসের নির্বাহী পরিচালক বলেন, “অ্যাকর্ডের টার্মস অ্যান্ড রেফারেন্সে এই বিষয়টি যোগ করা হয়নি। তবে নতুন প্ল্যাটফর্ম আরএসসিতে অবশ্যই এই জিনিসটা যোগ করতে হবে। পোশাক খাতের পরিবেশগত উন্নয়নের পাশাপাশি এখন শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

অ্যাকর্ডের অসমাপ্ত কাজ করবে আরএসসি

রুবানা হক জানান, আরএসসি গঠনের পরে অ্যাকর্ডের অসমাপ্ত কাজগুলো তারাই এগিয়ে নিয়ে যাবে।

মঙ্গলবারের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক শেষে তিনি জানান, আগামী ২৫ নভেম্বরের মধ্যে আরএসসি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করবে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে দেশের পোশাক কারখানাগুলোতে পরিদর্শন, সংস্কার পরামর্শ অন্যান্য কাজ শুরু করবে আরএসসি।

তিন পক্ষের যৌথ ইশতেহারে বলা হয়, বৈঠকে অংশ নেয়া পক্ষগুলো আগামী ২০২০ সালের মে মাসের মধ্যে অ্যাকর্ড এবং এর কার্যাবলির একটি সাবলীল হস্তান্তর নিশ্চিত করতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে।

এতে বলা হয়, আরএসসি প্রথমবারের মতো নেওয়া একটি জাতীয় উদ্যোগ, যা দেশীয় শিল্প, ব্রান্ড এবং ট্রেড ইউনিয়নকে একত্র করে একটি সমন্বিত কমপ্লায়েন্সের মানদণ্ড নিশ্চিত করবে। পর্যায়ক্রমে শিল্পসম্পর্ক, কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত বিষয়গুলো নিজেদের কার্যপরিধির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করবে আরএসসি।

২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং পরের বছর সাভারের রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিক নিহত হওয়ার পরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে ক্রেতা দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কারখানা পরিদর্শনে ইউরোপীয় ২২৮টি ক্রেতার সমন্বয়ে অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ এবং আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স গঠন হয়।

২০১৮ সালের ৩১ মে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের কার্যকারিতার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ ছাড়লেও অ্যাকর্ড তিন বছর সময় বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে নাখোশ হয় বাংলাদেশের কারখানা মালিকরা। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

পরে গত ৮ মে আরও ২৮১ কর্মদিবস কাজ করতে অ্যাকর্ড ও বিজিএমইএর মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। গত ১৯ মে ওই সমঝোতা চুক্তির অনুসারে উভয় পক্ষকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয় আপিল বিভাগ।

কীভাবে চলবে আরএসসি

বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বেনারকে বলেন, “আমরা ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় উপনীত হয়েছি। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন আইএলও আমাদের এ সমঝোতায় বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়েছে। ভয়-দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করেছি আমরা।”

তিনি বলেন, ‘আরএসসি আমরা সবাই মিলে চালাব। আরএসসি দুভাবে কাজ করতে পারে। একটি হলো ফাউন্ডেশন গঠনের মাধ্যমে এবং অন্যটি কোম্পানির মাধ্যমে। কোম্পানি হলে এটা অলাভজনক হবে

আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে রেজিস্ট্রেশন করব। সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অনুদানপুষ্ট হয়ে কাজ করবে আরএসসি,” বলেন রুবানা হক।

বিজিএমইএ নেতারা জানান, পোশাক শিল্প মালিকদের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের প্রতিনিধি, দেশ-বিদেশি শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা থাকবেন আরএসসির তদারকির দায়িত্বে। শুরুতে অ্যাকর্ড ও অ্যালয়েন্সভুক্ত কারখানাগুলোর তদারকি দিয়ে কাজ শুরু করবে আরএসসি। তবে ধীরে ধীরে বাকিগুলোও এর আওতায় আসবে।

প্রসঙ্গত, প্রায় চার হাজারের মতো কারখানায় চার লাখের বেশি শ্রমিক নিয়ে বাংলাদেশ চীনের পরে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী দেশ। দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির ১৫ ভাগের বেশি যুক্ত হয় এই খাত থেকে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।