পাটকল শ্রমিকদের আমরণ অনশন: দাবি পূরণে সময় চেয়েছে সরকার

জেসমিন পাপড়ি
2019.12.13
ঢাকা
191213_JUTE_MILL_STRIKE_1000.jpg পাটকল শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার দাবিতে শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের বিক্ষোভ। ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯।
[নিউজরুম ফটো]

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ১১ দফা দাবিতে আমরণ অনশনরত শ্রমিকদের দাবি পুরণের জন্য ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছে সরকার। শুক্রবার রাতে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের সাথে বৈঠকের পর এ তথ্য জানান শ্রমিক নেতারা।

অনশন কর্মসূচির চতুর্থ দিন শুক্রবার রাত সাড়ে দশটায় পাটকল শ্রমিকদের সাথে প্রতিমন্ত্রীর বৈঠক শেষ হয়। বৈঠকের পরে খুলনার প্লাটিনাম জুটমিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর বেনারকে বলেন, “এ বিষয়ে রোববার আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক ডাকা হয়েছে। এজন্য প্রতিমন্ত্রী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছেন।”

এদিকে শনিবার দিবাগত রাত সোয়া একটায় শ্রমিক নেতাদের সাথে আলোচনার পর তিন দিনের স্থগিতাদেশ মেনে নেন সাধারণ শ্রমিকরা।

রোববারের সভায় দাবি বাস্তবায়ন না হলে ১৭ ডিসেম্বর থেকে আবারো অনশন পালন করা হবে বলে বেনারকে জানান পাটকল শ্রমিক নেত্রী সাহানা শারমিন।

মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ১১ দফা দাবিতে গত ১০ ডিসেম্বর থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন দেশের ১২টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকরা। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের ডাকে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত আটটি পাটকলের শ্রমিকরা এই কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।

অনশন কর্মসূচির তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার মারা যান খুলনার প্লাটিনাম জুটমিলের হেসিয়ান তাঁতের শ্রমিক আব্দুস সাত্তার (৫৫)।

“তিন দিন ধরে অনশন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার পরে তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করছিলেন। এরপর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান,” বেনারকে বলেন হুমায়ুন কবীর।

তবে সরকার বলছে, অনশনে অংশ নিলেও আব্দুস সাত্তার অসুস্থতাজনিত কারণে মারা গেছেন।

শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব আলী আজম বেনারকে বলেন, “আন্দোলনরত অবস্থায় তিনি মারা যাননি। ওই শ্রমিক অনশন কর্মসূচি থেকে বাসায় ফিরে অসুস্থতাবোধ করলে জুটমিলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে হাসাতালে নেওয়া হলে তাঁকে মৃত পাওয়া যায়।”

“আজ শুক্রবার তাঁর জানাজা ও দাফন হয়েছে। তাঁর লাশ সৎকারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে,” বলেন তিনি।

পাটকল শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সচিব আলী আজম।

তিনি বেনারকে বলেন, “রোববারও এ সংকট নিসরনে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভার পরে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) পক্ষ থেকে শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করা হবে।”

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান খুলনায় শ্রমিকদের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এই সমস্যা সমাধানের জন্য সব রকম চেষ্টা করছি আমরা।”

অর্থ সংকটে লোকসানি খাত

শ্রমিকদের সাথে কথা বলার পরে খুলনার বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে বৃহস্পতিবার রাতে প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান জানান, মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন করার মতো পর্যাপ্ত অর্থের সংকট রয়েছে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “জাতীয় মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন করতে এক হাজার একশ তিন কোটি টাকার প্রয়োজন। রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকলগুলোর পণ্য বিক্রি করে এ অর্থ যোগাড় করা সম্ভব নয়। এ কারণে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে।”

প্রতিমন্ত্রীর সাথে শুক্রবার বৈঠক শুরুর আগে শ্রমিক নেতা হুমায়ুন কবীর বেনারকে বলেন, “২০১৫ প্রধানমন্ত্রী ছয়টি সেক্টরে মজুরি কমিশন ঘোষণা করেন। অন্য পাঁচটি সেক্টরে মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন হলেও পাটকল শ্রমিকদের জন্য তা বাস্তবায়ন হয়নি।”

“গত চার বছরে শ্রমিকরা যতবারই আন্দোলনে নেমেছেন ততবারই আশ্বাসের মাধ্যমে তাঁদের আন্দোলন থেকে বিরত রাখা হয়েছে। যতক্ষণ দাবি আদায় না হবে শ্রমিকরা এবার পিছু হটবে না,” বলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, পাট খাতকে লাভজনক করার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এসে বিজেএমসিকে লাভজনক করতে কর্মপরিকল্পনা নেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেওয়া বিভিন্ন পাটকল নতুন করে সরকারিভাবে চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বর্তমানে পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন ২৬টি পাটকলের মধ্যে ২৫টি চালু রয়েছে। ২২টি জুট ও ৩টি নন-জুট মিলের মধ্যে ২৪ প্রতিষ্ঠানই বর্তমানে লোকসানে রয়েছে। কেবলমাত্র মিলস ফার্নিশিংস লিমিটেড নামের একটি নন-জুট কারখানা লোকসানে নেই।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিজেএমসির সকল পাটকলের (জুট ও নন-জুট) লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪৮১ কোটি টাকা।

ভর্তুকির শিল্প বন্ধের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

বিশ্লেষকেরা বলছেন, দুর্নীতি, পুরোনো প্রযুক্তির ব্যবহার, অদক্ষতা, পণ্যে বৈচিত্র্য না থাকা, সর্বোপরি জবাবদিহিতার অভাবে পাটকলগুলো মরতে বসেছে। বছরের পর বছর ভর্তুকি দিয়ে চালিয়ে নেওয়া পাটকলগুলো বন্ধ করার সময় এসেছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বেনারকে বলেন, রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকলগুলোতে পুরোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার, পেশাগত অদক্ষতার পাশাপাশি শ্রমিকদের সংখ্যাও অনেক বেশি। এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ তো রয়েছে।”

“তারা বেশি দামে নিম্নমানের পাট কিনছে। পণ্যে বৈচিত্র্য নেই। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পাটজাত পণ্যের চাহিদাও বাড়ছে না,” বলেন তিনি।

তিনি বলেন, “এসব কারখানায় প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব না থাকায় কাজের দক্ষতা বাড়ানোর উৎসাহ নেই। ফলে উৎপাদনশীলতাও অনেক কম, রয়েছে বিরাট লোকসান।”

ড. ফাহমিদার মতে, “জনগণের করের অর্থে ভর্তুকি দিয়ে একটি খাতকে বাঁচিয়ে রাখা একেবারেই অনুচিত। এখন এসব কারখানা বন্ধ করে দিয়ে সম্ভাবনাময় শিল্পের দিকে নজর দেওয়া উচিত।”

এদিকে পাটকলগুলোর লোকসানের জন্য সরকারের নীতিকে দায়ী করছেন শ্রমিকেরা।

এ প্রসঙ্গে শ্রমিক নেতা হুমায়ুন কবীর বেনারকে বলেন, “লোকসান হলেই শ্রমিকদের দোষ দেওয়া হয়। কিন্তু বিজেএমসি মৌসুমে সময়মত পাট না কেনার ফলে কোটি কোটি টাকা দিতে হয়।”

তিনি বলেন, প্রতিবছর মৌসুমে ১২০০ টাকা মণে পাট কেনা যায়। কিন্তু সে সময় বিজেএমসি টাকা না দেওয়ায় এখন সেই পাট ২২০০ টাকা করে কিনতে হচ্ছে।”

তিনি নিজের কারখানার উদাহরণ দিয়ে বলেন, “প্লাটিনাম জুট মিলে বছরে পাট লাগে ছয় লাখ মণ। অসময়ে কেনায় মণপ্রতি ৮০০ টাকা করে বাড়তি দিয়ে ছয় লাখ মণ পাট কিনতে ৪৮ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।