প্রিজন ভ্যানে হামলার পরিকল্পনাকারী আল্লাহর দলের চার জঙ্গি গ্রেপ্তার

শরীফ খিয়াম
2019.08.19
ঢাকা
প্রিজন ভ্যানে হামলার পরিকল্পনাকারী   আল্লাহর দলের চার জঙ্গি গ্রেপ্তার হাতিরঝিল থেকে র‌্যাব সদস্যরা চার জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে বলে জানায় র‌্যাব ঢাকা আগস্ট ১৯, ২০১৯
ছবি বেনার নিউজ

জঙ্গি সংগঠন আল্লাহর দল বা আল্লাহর সরকারের ভারপ্রাপ্ত আমির ইব্রাহিম আহমেদ হিরোসহ (৪৬) চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব ঢাকার হাতিরঝিল এলাকা থেকে রোববার রাতে তাদের আটক করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা হলেন গাইবান্ধার আব্দুল আজিজ (৫০), পাবনার শফিকুল ইসলাম সুরুজ (৩৮), কুড়িগ্রামের রশিদুল ইসলাম (২৮)। তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু মোবাইল সিম, সেট, পেনড্রাইভ ও হার্ডড্রাইভ উদ্ধার করা হয়েছে।

সোমবার এক বিশেষ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব জানায়, উগ্রবাদী এই গোষ্ঠী নিজেদের প্রধান নেতা মতিন মেহেদী ওরফে মতিন মাহবুবকে জেল থেকে মুক্ত করতে ‘প্রিজন ভ্যানে’ হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল।

তারা বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক বাহিনীর চাকরিচ্যুত বা অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের নিজেদের দলে ভেড়াতে চেষ্টা করেছিল বলেও উল্লেখ করেছে র‌্যাব

এ ব্যাপারে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সংগঠনটিতে সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ঝামেলা এড়াতে বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্তদের টার্গেট করা হয়।”

“এ ক্ষেত্রে তারা পিলখানার ঘটনায় চাকরিচ্যুতদের নিজেদের দলে ভেড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছিল। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতার কারণে তাদের এই চেষ্টা সফল হয়নি,” যোগ করেন র‌্যাব -৩ অধিনায়ক (সিও)।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বেনারকে বলেন, “সাধারণত যাদের সহজে উগ্রপন্থী বানানো যায়, তাদের দিকেই নজর থাকে জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর। বাংলাদেশে প্রথমে মাদ্রাসা এবং পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের শিকার হয়েছে।”

“ওই সব ক্ষেত্রে সবাই এখন অনেক সচেতন বলে শিকার বদলাতে বাধ্য হয়েছে জঙ্গিরা। এখন তাদের ‘টার্গেটে’ (লক্ষ্যে) আছে, যাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে তারা। তাদের দলে ভেড়ানো সহজ মনে করছে এই জঙ্গিগোষ্ঠী,” বলেন তিনি।

আল্লাহর দলের ১৮ সদস্য আটক

দীর্ঘদিন থেকে র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকা আল্লাহর দল বা আল্লাহর সরকার সশস্ত্র সংঘাত ও নাশকতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে উৎখাত করে উগ্রবাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায় উল্লেখ করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল।

তিনি জানান, বিভিন্ন সময়ে তাদের ১৮ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব । এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে খুলনায় তিন, ঢাকায় চার, রংপুরে তিনজনকে আটক করা হয়। এছাড়া ২০১০ সালে তাদের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মেজর জেনারেল (অব.) রশীদ বলেন, “বড় সংগঠনগুলো যখন নজরদারির মধ্যে বেশি থাকে তখন এমন ছোট ছোট দলগুলোর মাধ্যমেই সংগঠিত হয় জঙ্গিরা। এটা তাদের একটি পুরোনো কৌশল।”

মেজর রশিদ বলেন, “জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যে প্রক্রিয়া, বর্তমানে বাংলাদেশ সে অনুযায়ীই চলছে। তাই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর অধিকাংশ শীর্ষ নেতাই এখন কারাবন্দী, পুলিশ ও র‌্যাব তাদের সাংগঠনিক কাঠামোও ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে।”

“ফলে পরিকল্পনা করলেও হামলার সক্ষমতা হারিয়েছে তারা,” বলেন ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (আইসিএলডিএস) এই নির্বাহী পরিচালক।

আল্লাহরদলথেকেসরকার

মতিন মেহেদী বা মতিন মাহবুবের নেতৃত্বে ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করে আল্লাহর দল। তাদের প্রধান নেতা মুমিনুল ইসলাম ও মতিনুল হক নামেও পরিচিত। ২০১৪ সালে তারা কৌশলগত কারণে সংগঠনের নামকরণ করে ‘আল্লাহর সরকার’।

এর আগে ২০০৪ সালের শেষের দিকে তারা জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সাথে একীভূত হয়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের সিরিজ বোমা হামলার পর সদস্যরা গ্রেপ্তার হতে শুরু করলে জেএমবি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করে।

ওই সময়ে জঙ্গি মতিন তাঁর অনুসারীদের নিয়ে জেএমবি ত্যাগ করেন। নিজের সংগঠনকে পুনরায় সংগঠিত করার চেষ্টাকালে ২০০৭ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। তবে তাঁকেই আমির মেনে নতুন করে সংগঠনটিকে সক্রিয় করেন ইব্রাহিম।

১৯৯৭ সালে মতিনের কাছে বায়াত নেওয়া পাবনার এই ব্যক্তিই সংগঠনটির অধিনায়ক হিসেবে আর্থিক ব্যবস্থাপনা, দাওয়াতি ব্যবস্থাপনা, সদস্য নিয়োগ, মামলা মোকদ্দমাসহ সার্বিক বিষয় তদারকি করেন।

র‌্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা তাদের কারাবন্দী নেতা মতিনকে ‘ফিল্মি স্টাইলে’ মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। প্রিজন ভ্যানে হামলার কয়েকটি পরিকল্পনা এবং তার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের তথ্যও দিয়েছে তারা।

এর আগে ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে ও পুলিশ হত্যা করে বোমা মিজানসহ জেএমবির তিন নেতাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল জঙ্গিরা।

জঙ্গিদের অর্থ নারীদের নামে

আল্লাহর সরকার ব্যক্তি পর্যায়ে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি জাকাতের টাকাও জঙ্গিবাদে ব্যবহার করে।

নামে বেনামে বেশ কয়েক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে এই জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর। ব্যবসার লাভসহ তাদের যাবতীয় মূলধনে একটি বিরাট অংশ মহিলাদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে বলে জানতে পেরেছে র‌্যাব।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক রশীদের ধারণা, “যত দিন পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে এদের সংযোগ বিচ্যুত না করা যাবে, তত দিনই তারা এভাবে মাঝে মাঝেই মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করবে।”

আল্লাহর সরকারের সদস্যদের দাবি, বর্তমান পরিস্থিতি একটা যুদ্ধাবস্থা। তাই ঈদ, কোরবানি, হজ, এমনকি জুমার নামাজেও অংশ নেয় না তারা। ইসলামের কালেমার সঙ্গে শেষ নবীর নাম যুক্ত করার ক্ষেত্রেও তাদের ভিন্ন মত আছে।

তাদের নেতা মতিন ‘আল্লাহর বিশেষ দূত’ হয়ে উঠতে পারেন বলে মনে করেন তারা।

র‌্যাবের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের তুলনায় ‘আল্লাহর দল’ নামের এই জঙ্গি সংগঠনের অবকাঠামো বিন্যাস কিছুটা ভিন্ন। গ্রাম পর্যায়ে ‘নায়ক’ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পদ ‘আমির’ বা ‘তারকা’ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে। এদের অধিনায়ক, উপ-অধিনায়ক, অতিরিক্ত অধিনায়ক পদ রয়েছে।

বর্তমানে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলায় সদস্য সংগ্রহ করছে তারা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।