সর্বোচ্চ সংক্রমণের মধ্যেই মসজিদ খুলে দেওয়া হল
2020.05.06
ঢাকা
সীমিত আকারে চালু থাকা দেশের মসজিদগুলোতে ওয়াক্ত, তারাবি এবং জুমার নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়েছে সরকার। করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ১০ মে থেকে ‘সীমিত আকারে’ ব্যবসা-বাণিজ্য চালুর ঘোষণা দেওয়ার একদিন পরেই বুধবার সব মসজিদ খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গত ৬ এপ্রিল থেকে খুবই সীমিত আকারে মসজিদে নামাজ হচ্ছিল। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি পালন করার শর্তে বৃহস্পতিবার থেকে মসজিদে সব ধরনের নামাজ পুরোদমে অনুষ্ঠিত হবে।
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ বুধবার বেনারকে জানান, বৃহস্পতিবার জোহরের ওয়াক্ত থেকে সকল মসজিদে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও তারাবি নামাজ আদায় করা যাবে। তবে অন্যান্য ধর্মীয় উপসনালয় এখনই খুলছে না।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “মসজিদ খুলে দেয়ার জন্য আলেম-ওলামাদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে খুব জোরালো দাবি ছিল। তাদের দাবি বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি পালন করার শর্তে আমরা মসজিদ খুলে দিচ্ছি।”
বুধবার মসজিদ খুলে দেয়া সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। আদেশে সামাজিক দূরত্ব ও কিছু স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে যেসব বিষয় হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে সরকারকে বলা হয়েছিল।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটছে। এ্ই অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও মসজিদ খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত দেশের জন্য মারাত্নক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, গত ২৪ ঘন্টায় দেশে মোট ৭৯০ জন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। এটিই এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ৭১৯। গত ২ মে থেকে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
নাসিমা সুলতানা বলেন, গত ২৪ ঘন্টায় মারা গেছেন আরও তিনজন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মোট ১৮৬ জন মারা গেলেন।
বেশ কিছু শর্ত মানতে হবে
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সারা দেশে জনসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ম মন্ত্রণালয় মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমা ও তারাবির জামাত সীমিত আকারে আদায়ের জন্য নির্দেশনা জারি করেছিল।
দেশের শীর্ষ আলেম-ওলামাগণ পবিত্র রমজানের গুরুত্ব বিবেচনা করে মসজিদে নামাজ আদায়ের শর্ত শিথিল করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবি জানিয়েছেন। এর মধ্যে সম্প্রতি সরকার সার্বিক বিবেচনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নির্দেশনা (স্বাস্থ্যবিধি) মেনে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে বৃহস্পতিবার জোহর থেকে সুস্থ্য মুসল্লিদের মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়ের পরামর্শ দিয়েছে। অবশ্য বেশ কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
শর্তগুলো হলো; মসজিদে কার্পেট বিছানো যাবে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে মসজিদ জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। মুসল্লিরা নিজ দায়িত্বে জায়নামাজ নিয়ে যাবেন। মসজিদের প্রবেশদ্বারে স্যানিটাইজার, হাত ধোঁয়ার ব্যবস্থাসহ সাবান-পানি রাখতে হবে। মুসল্লিদের অবশ্যই মাস্ক পরে মসজিদে ঢুকতে হবে।
প্রত্যেককে নিজ নিজ বাসা থেকে ওজু করে ও সুন্নত নামাজ ঘরে আদায় করে মসজিদে যেতে হবে। ওজু করার সময় কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। নামাজের কাতারে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব, অর্থাৎ তিন ফুট পর পর দাঁড়াতে হবে।
শিশু, বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ্য ব্যক্তি ও অসুস্থ্যদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি জামাতে অংশ নিতে পারবেন না।
সর্বসাধারণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্দেশনা অবশ্যই মানতে হবে।
এ ছাড়া মসজিদে ইফতার ও সাহরির আয়োজন করা যাবে না।
মসজিদ খুলে দেয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক ও আহমদ শফির ছেলে আনাস মাদানী বেনারকে বলেন, “সরকারের কাছে আমাদের দাবি ছিল, মাহে রমজানের পবিত্রতা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মসজিদ খুলে দেয়া হোক। সরকার আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। এ জন্য আমরা খুশি।”
পরিস্থিতি মারাত্নক হতে পারে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, প্রতিদিন বাংলাদেশে করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
“আমরা মঙ্গলবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন করোনাভাইরাস সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভায় ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে দেয়ার সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেছি। সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়বে। আমিও তাই মনে করি। জাতীয় কমিটির সভায় আমি একই কথা বলেছি।”
তিনি বলেন, “আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা আছে। হাজার হাজার করোনাভাইরাস রোগীর চিকিৎসা দেয়ার মত সক্ষমতা অথবা অবকাঠামো—কোনোটিই আমাদের নেই।”
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ড. কনক বলেন, “আজকে আমাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বৌদ্ধ পূর্ণিমা পালিত হচ্ছে। তবে বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা প্যাগোডায় না গিয়ে বাসায় পূজা করার কথা বলেছেন। আমি মনে করি্ এই সিদ্ধান্ত সঠিক। কারণ, জনস্বাস্থ্য আগে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরে। আগে মানুষকে বাঁচতে হবে।”
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে দেয়া হলে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে, এটা সত্য। কিন্তু যখন সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী শনাক্ত হচ্ছে, সেই সময় খুলে দেয়াটা বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত বলে মনে হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আমেরিকা-ইউরোপের দেশগুলো তখনই খুলছে, যখন তাদের সংক্রমণের প্রবণতা কমতির দিকে। আর আমাদের দেশে হচ্ছে উল্টো। মনে হয়, আরও কিছুদিন সবকিছু বন্ধ রাখা উচিত ছিল।”