ঢাকায় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় দুই জন আটক

প্রাপ্তি রহমান ও জেসমিন পাপড়ি
2019.10.14
ঢাকা
ঢাকায় পুলিশের ওপর হামলার  ঘটনায় দুই জন  আটক নব্য জেএমবি সন্দেহে দুইজনকে আটক করেছে পুলিশ। ঢাকা ১৪ অক্টোবর, ২০১৯।
ছবি: বেনার নিউজ

ঢাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন হামলা কিংবা হামলা চেষ্টার মূল পরিকল্পনা ও নেতৃত্বদানকারী দুই ‘জঙ্গিকে’ আটক করার কথা জানিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।

রোববার রাত আটটার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। পুলিশ বলছে, এই দুজনই নব্য জেএমবির সদস্য।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, তাদেরই পরিকল্পনা এবং নেতৃত্বে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে পুলিশের ওপর ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) হামলা করা হয়েছে।”

গত মাসে ফতুল্লার যে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছিল, সেখানে বসে তৈরি করা বোমাগুলোই ঢাকায় বিভিন্ন হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে বলেও জানান মনিরুল ইসলাম।

গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে; মো. মেহেদী হাসান তামিম ও মো. আবদুল্লাহ আজমির।

পুলিশ জানায়, তারা দুজনই খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তারা নিষিদ্ধ সংগঠনের সাথে যুক্ত হয় এবং ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তারা ভোলার একটি দুর্গম চরে প্রশিক্ষণ নেয়।”

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কাজী সাজ্জাদ হোসেন বেনারকে বলেন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে জড়ানোর খবর শুনছেনে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

“সাম্প্রতিক সময়ে পরপর দুটি ঘটনায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নাম এসেছে। কেন তারা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হলো খোঁজখবর করতে শুরু করেছি,” বলেন তিনি।

মেধাবী শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদ বা চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার জন্য বিদ্যমান রাজনীতি এবং গতানুগতিক শিক্ষাকে দুষছেন বিশ্লেষকেরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বেনারকে বলেন, “প্রকৌশল বিদ্যায় আমাদের চিরাচরিত যে পাঠ্যক্রম, তাতে মানবিক দিক বা সামাজিক শিক্ষা বলতে যা বোঝায় তা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত।”

“ফলে তাঁরা মেধাবী হলে মনের মধ্যে যেসব সামাজিক প্রশ্ন থাকে তার উত্তর খুঁজে পায় না। এ কারণে প্রকৌশল এমনকি মেডিকেল শিক্ষার্থীরাও চরমপন্থাসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে,” বলেন তিনি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বেনারকে বলেন, “একটা রাজনৈতিক বিশ্বাস বা মতবাদের জায়গা থেকে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে মানুষ। সেটা শ্রমিক থেকে শুরু করে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী যে কেউ হতে পারে।”

“জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে চালানো হচ্ছে। যারা এর সাথে জড়িত, তারা গ্রামে-গঞ্জে, শহরে, স্কুল–কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্যাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। তারাই মানুষকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করছে,” বলেন তিনি।

পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ ও তিনটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের দুজনের প্রত্যেককে পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।

ফতুল্লার আস্তানা ছিল কারখানা

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলছেন, “গত মাসে ফতুল্লার জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছিল। সেখানে বসে তৈরি করা বোমাগুলোই ঢাকায় বিভিন্ন হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে।”

এই পুলিশ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, গত ২৩ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ থেকে আটক ফরিদ উদ্দিন রুমির ছোট ভাই জামাল উদ্দিন রফিক গ্রেপ্তার হয়। রফিকের নেতৃত্বে এ বছরের শুরুর দিকে সংগঠনটির একটি সামরিক শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ লক্ষ্যে মেহেদী হাসান ও আবদুল্লাহ আজমির ফতুল্লায় রফিকের বাসায় বোমা তৈরির কারখানা গড়ে তোলে।

মনিরুল ইসলাম জানান, রোববরার রাতে আটককৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন যে, গত ২৯ এপ্রিল গুলিস্তানে এবং ৩১ আগস্ট সাইন্সল্যাবে বোমা (আইডি) হামলায় তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। এ ছাড়া মালিবাগ, পল্টন ও খামারবাড়ির বোমা হামলায় ব্যবহৃত বোমা তৈরিতেও তাঁরা বন্ধু রফিককে সহায়তা করে।

তিনি জানান, অতি সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার তক্কার মোড়ে পরিচালিত জঙ্গি বিরোধী অভিযানস্থলে তারা নিয়মিত শলাপরামর্শ করাসহ বিভিন্ন ধরনের বোমার (আইইডি) উৎকর্ষ সাধনে তৎপর ছিল। তাদের অন্য সহযোগীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

পুলিশের ওপর যত হামলা

গত ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় আইএসের (ইসলামিক স্টেট) হামলার পর থেকেই জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলার আশঙ্কা করছিল পুলিশ। এর সাত দিনের মাথায় ঢাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা হয়। প্রথম হামলাটি হয় ২৯ এপ্রিল। সেদিন গুলিস্তানে পুলিশের ওপর হামলায় ট্রাফিকের দুই কনস্টেবলসহ কমিউনিটি পুলিশের একজন আহত হন।

এরপর ২৬ মে মালিবাগে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অফিসের সামনে হামলা হয়। এতে উপপরিদর্শক রাশেদা ও একজন রিকশাচালক আহত হন।

জুন মাসে কোনো হামলা হয়নি। তবে ২৩ জুলাই খামারবাড়ি ও পল্টনে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে একই সময়ে দুটি বোমা উদ্ধার করা হয়।

এরপর গত ৩১ আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম সায়েন্স ল্যাবরেটরি অতিক্রম করার সময় হামলায় পুলিশের একজন উপসহকারী পরিদর্শক ও একজন কনস্টেবল আহত হন।

এপ্রিল থেকে পুলিশের ওপর ধারাবাহিক হামলার ঘটনা ঘটলেও এর পেছনে কারা সেটি খুঁজে বের করতে পুলিশকে বেগ পেতে হয়েছে।

৩১ আগস্টের হামলার পর পুলিশ সদরদপ্তর অধীনস্থ সবগুলো বাহিনীকে সম্পৃক্ত করে। গত ২ সেপ্টেম্বর বিকেলে পুলিশ সদর দপ্তরের জরুরী সভায় পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ হয়।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারীর নেতৃত্বে এবং পুলিশ, সিটিটিসি, এটিইউ, এসবি, সিআইডি, পিবিআই ও র‍্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওই সভায় উপস্থিত হন।

ওই বৈঠকের ১৮ দিনের মাথায় পুলিশ যাত্রাবাড়ি থেকে মিজান নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (পরে বহিষ্কৃত) ফরিদউদ্দীন রুমিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর ভাই খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থী জামালউদ্দীন পালিয়ে যান। পুলিশ জানায়, পুলিশের ওপর হামলায় এরা জড়িত ছিলেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।